কমিটির বছরপূর্তি বুধবার, এখনও দাঁড়াতে পারেনি ছাত্রদল

দেখতে দেখতে এক বছর পূর্তি হলেও এখনও নিজেদের পূর্ণাঙ্গই করতে পারেনি বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গত বছরের ১৪ অক্টোবর রাজিব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসান মিন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আংশিক ওই কমিটি ১৫১ সদস্যের। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রদলের কমিটি ১৫১ সদস্যেরই। কিন্তু কমিটি ঘোষণার সময় বলা হয়, ২০১ সদস্যের পূর্নাঙ্গ কমিটি দেয়া হবে। আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

বর্তমান কমিটি ঘোষণার পর পরই বিদ্রোহের মুখে পড়ে ছাত্রদল। হয় হাঙ্গামা-হানাহানি। বিদ্রোহীদের কমিটি বিরোধী অবস্থানকে কেন্দ্র করে কয়েকদিনের হাঙ্গামা-সংঘর্ষে গুরুতরভাবে আহত হয় অনেক নেতাকর্মী। একপর্যায়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, সিনিয়র নেতারা বিদ্রোহ দমনের বিষয়ে উদ্যোগ নেন। এক পর্যায়ে সামনে চলে আসে বিএনপির সরকার বিরোধী টানা আন্দোলন। আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের আপাতত অবসান ঘটলেও তা মূলত রয়েছে চাপা দেয়া অবস্থায়। যে কোনো সময় আবারও কমিটি বিরোধী বিদ্রোহ সামনে আসতে পারে বলে আশংকা সংগঠনের নেতাকর্মীদের।

ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, রাজিব-আকরাম কমিটি ঘোষণার পর থেকেই এ কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর। যারা কমিটিতে পদ পেয়েছেন আবার যারা পদ বঞ্চিত হয়েছেন তারাও কমিটির প্রতি নিজেদের অনাস্থার কথা বিভিন্ন সময় প্রকাশ করেছেন। এরমধ্যে কমিটির অন্যতম সহসভাপতি মাসুদ পারভেজ, সাদিউল কবির নিরব, আলমগীর হাসান সোহান, হুময়ান কবির ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ আরেফিন, কাজী মুক্তার পদত্যাগের ঘোষণাও দেন।

কমিটির বর্ষপূর্তি সামনে রেখে সংগঠনের অন্যতম কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘১৪ অক্টোবর ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির ১ বছর পূর্তি হবে। এক বছরের মধ্যে আমরা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরসহ (সুপার ইউনিট) বর্তমান কেন্দ্রীয় আংশিক কমিটিকেও পূর্ণাঙ্গ করতে পারিনি। পারিনি গত প্রায় এক বছরে রাজপথের রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য পারফর্মেন্স দেখাতে (যদিও বিগত তিন মাসের আন্দোলনে অন্য অঙ্গ-সংগঠনগুলোর চেয়ে ছাত্রদলের ভূমিকা কিছুটা হলেও সক্রিয় ছিল)। তাই যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনের পুনর্গঠনের মতো ছাত্রদলকে নিয়েও ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত আসবে বলে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা প্রত্যাশা করে।’

সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ আরেফিন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির বছর পূর্তির বিষয়ে বলেন, ‘আমি বিগত এক বছরে বর্তমান কমিটির কোনো সফলতা দেখিনা। আমার চোখে পড়েনি। আপনার চোখে কি পড়েছে; পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি।

আরেফিন বলেন, বিগত সময় সংগঠনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা নিজ নিজ দায়িত্বে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে। এতে কেন্দ্রের কোনো সহযোগীতাও যেমন ছিল না, ছিলনা কোনো সমন্বয়ও। এমনকি কেন্দ্র থেকে নেতাকর্মীরা কোনো গাইডলাইনও কখনও পায়নি। তাই বছর পূর্তিতে সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা সময় এসেছে ছাত্রদলকে নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখার। আশাকরি ম্যাডাম দেশে ফিরে নতুন কমিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

জানা যায়, গত এক বছরের মধ্যেও বর্তমান আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি ছাত্রদল। পারেনি রেওয়াজ অনুযায়ী বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আনুষ্ঠানিক শপথ নিতে। এমনকি এই এক বছরেও বর্তমান কমিটি একত্রিত বসে একটি বৈঠকও করতে পারেনি। অবশ্য এজন্য দেশের অস্বাভাবিক রাজনীতিকে দায়ী করে আসছেন সংগঠনের দায়িত্বশীলরা।

কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া নেতাদের মধ্যে বিগত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রয়েল দ্য রিপোর্টকে বলেন, দেখতে দেখতে এক বছর পূর্তি হলেও বর্তমান ব্যর্থ কমিটি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিও করতে পারেনি।

তিনি বলেন, নতুন কমিটি ঘোষণার পর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ট্রাডিশন (ঐতিহ্য) হচ্ছে শেরেবাংলা নগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর কেন্দ্রীয় নেতারা শপথ নেবেন। কিন্তু এ ব্যর্থ কমিটি আজ পর্যন্ত তাও করতে পারেনি। এমনকি ১৫১ সদস্যর যে আংশিক কমিটি গত এক বছর ধরে একত্রে কোথাও একটি বৈঠক করতে পারেনি।

রয়েল আরও বলেন, পকেট কমিটি দিয়ে আর যাই হোক, রাজনীতি হয় না। এরা সম্পূর্ন ব্যর্থ। এরা কোন কমিটি গঠন করতে পারে নাই। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এদের নেতৃত্বে দেখতে চায় না।

তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিদেশ যাওয়ার আগে আমরা( ছাত্রদলের নেতারা) ম্যাডামের সাথে দেখা করেছি। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এবং বলেছেন তিনি দেশে এসে ব্যবস্থা নেবেন।

রয়েল আরও বলেন, বিগত আন্দোলনে কমিটির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকসহ অধিকাংশই নেতাই হয় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল, না হয় পলাতক ছিল। তারা যোগাযোগের মোবাইল নম্বরটা পর্যন্তও বন্ধ রেখেছিল, যাতে জীবনবাজী রেখে যেসব নেতাকর্মী সরকারের গুলির মুখে রাজপথে নামার চেষ্টা করেছেন তারা যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন। এ কমিটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এদের দিয়ে বিএনপির কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হবে না। তাই আমাদের অভিভাবক ম্যাডাম (খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান) ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন জানাই অবিলম্বে এ ব্যর্থ কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে সাধারণ ছাত্র-নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নতুন কমিটি উপহার দেয়ার। আশাকরি ম্যাডাম দেশে ফিরে এ ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেবেন।

ছাত্রদল সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার দুই মহানগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার কমিটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরলে তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

ছাত্রদলের সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় কমিটি এখনই পূর্ণাঙ্গ করা হচ্ছে না। অনেকের আশংকা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে গেলে আবারও সংগঠনের ভেতরে বিক্ষোভ দেখা দেবে।

২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর গত বছর নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও অন্য শাখাগুলোতে কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।

সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটির খসড়া করেছে বর্তমান কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটি সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক পর্যায়ের দুজনকে খসড়া কমিটিতে শীর্ষ পদে রাখা হয়েছে। বাকি পদগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের রাখা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি ও ছাত্রদল নিয়ে সক্রিয় সাবেক নেতাদের একটি পক্ষ চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ছাত্রদের দিয়ে করতে। এর মধ্যে আবার ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। এ দুই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি আটকে আছে।

সূত্র জানায়, এখনও প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের দিয়েই কমিটির ঘোষণা আসতে পারে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর ছাত্রদলকে দুই থেকে চার ভাগে ভাগ করার কথাও শোনা যাচ্ছে বিএনপিতে।

ছাত্রদলের সূত্র জানায়, এসবের বাইরে জেলা কমিটিগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। গড়ে সাত/আট বছর ধরে জেলায় কমিটি নেই। ফলে মাঠপর্যায়ে সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

সংগঠনটির সহসভাপতি নাজমুল হাসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ঢাকার বাইরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদলের কমিটি আছে, তবে তা অনেক আগেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। অনেক কমিটির কার্যক্রম নাই বললেই চলে। যে কারণে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকতে পারি না। ডাকলেও কার্যত কর্মসূচি সফল হয় না।

নাজমুল বলেন, কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আমরা অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। এরপর থেকে পুলিশের হামলা-মামলা-নির্যাতন চলছে। রীতিমত একটি অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। সংগত কারণেই কমিটি পূর্ণাঙ্গ বা অন্যান্য পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আমরা আশা করছি ম্যাডাম দেশে ফিরলে আমরা আমাদের বাকী কাজগুলো দ্রুত এগিয়ে নিতে পারব।

কমিটির বছর পূর্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর