এ সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাক পাখি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এ দেশের লোকালয়ে কাক, চিল ও শালিকের মতো পাখির অভাব নেই। এসব পাখি দেখেই অনেকে ভাবেন, পাখিরা এ দেশে ভালোই আছে। আসলে তা নয়, বাংলাদেশে পাখির অবস্থা করুণ। পাখির আবাস এ দেশে দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শতাধিক পাখির জন্য বিদায়ের ঘণ্টা বাজানো হয়ে গেছে। সম্ভবত আগামী দু’তিন দশকেই এ দেশের শতাধিক আবাসিক পাখি উৎখাত হয়ে যাবে। কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি।

তবে আমাদের লোকালয়ের কিছু পাখির অবস্থা কিন্তু ভালোই আছে। ভালো আছে বলতে পারি এমন পাখির তালিকায় রয়েছে তিরিশটি প্রজাতি। কাক, চিল, পায়রা, টিয়া, ফিঙে, দোয়েল, শালিক, চড়–ই এসব পাখি। এই পাখিরা বেশ কিছুকাল ধরে লোকালয়ে বসবাস শুরু করেছে। এরা আমাদের বর্জ্য খেতেও অভ্যস্ত হয়েছে। অনেকে আমাদের দালান-কোঠায় বাসা বাঁধার কৌশলও আবিষ্কার করেছে। নগরীর নর্দমায়, আবর্জনা-স্তূপে আর ভাগাড়েই এদের নিত্য আনাগোনা। বর্জ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পাখিদের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। এদের ওড়াউড়ি দেখেই শহুরে মানুষের মনে হয় এ দেশে অনেক পাখি আছে।

লোকালয়ে পাখি দেখে আসলে বোঝা যায় না এ দেশের বাকি তিনশ প্রজাতির কী হাল! গাঁয়ের বয়োবৃদ্ধ লোকেরা পাখির হাল-হকিকত আমাদের চেয়ে ভালো জানেন। তারা জানেন যে বক, বটেরা, বালিহাঁস, ডাহুক, কোড়া, কালেম, ঘুঘু, হরিয়াল, প্যাঁচা, শকুন ইত্যাদি অতি চেনা পাখিও গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

শহর ও নগরীর গিছেড়ে গেলেই পাখির অনুপস্থিতি আপনি বুঝতে পারবেন। ধরুন আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। যাত্রাপথে আপনি ক’টি বক অথবা ঘুঘু দেখতে পাবেন? আমরা বটেরা, বালিহাঁস, কোড়া, শকুন ইত্যাদি দুর্লভ পাখির কথা বলছি না। আপনি অতি সুলভ বলে কথিত বক ও ঘুঘু পাখি গুনে দেখুন। আপনি শত শত কিলোমিটার পথ পার হচ্ছেন। পথের দু-পাশে বিস্তীর্ণ জলাশয়ে পানি থইথই। পাইলনের ওপর সারি সারি বিদ্যুতের তার। আপনি কি পানিতে দু-তিন হাজার বক এবং তারে বসা চার-পাঁচশ ঘুঘু দেখতে পাবেন! মোটেই না; সম্ভবত দু-তিনটিও নয়।

এককালে বর্ষায় বাংলাদেশে এক কিলোমিটার পথ পার হতে গেলে পথপাশে দশ-বিশটি বক চোখে পড়াই তো স্বাভাবিক ছিল। প্রতি কিলোমিটার পথে দু-এক জোড়া ঘুঘুর দেখাও মিলত সব ঋতুতেই। এখন শত কিলোমিটারে একটি বক কিংবা ঘুঘুর দেখা পেলে আমরা ভাগ্য মানি। বিগত তিন-চার দশকে পাখিরা সব কোথায় পালিয়ে গেল এ দেশ থেকে!

আশ্চর্যের ব্যাপার, পাখির তিরোধানের ঘটনাটা ঘটল অতি নিঃশব্দে! কেউ কোনো শোরগোল করলেন না এ নিয়ে। সবাই যেন এটাকে ভবিতব্য বলেই মেনে নিলেন। যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। অধিকাংশ মানুষ হারিয়ে যাওয়া পাখির কথা ভুলেও গেলেন। হয়তো ভাবলেন, আরে ভাই কাক, চিল, শালিকেরা তো আছে, এতেই চলবে। যদি প্রশ্ন করেন, তিনশ প্রজাতির পাখি না হলে কি আর এ দেশ চলবে না! আমি বলব, ‘চলবে, তবে চলবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পোলিও রোগে এক পা বিকল হলেও তো মানুষের জীবন চলে। কিন্তু এমন জীবনের প্রত্যাশা কেউ করে না এবং সম্ভব হলে তা এড়িয়ে চলার ব্যবস্থা নেয়।’

বাংলা দেশে তিন শতাধিক প্রজাতির স্থায়ী বসবাসকারী পাখি আছে। আছে বলেই বোঝা যায় যে, এ দেশের প্রকৃতিতে এদের প্রয়োজনও আছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নির্ধারণ করে কোথায় কোনো জীব টিকে থাকতে পারবে। প্রকৃতিতে অপ্রয়োজনীয় জীব তো বেশি দিন টিকে থাকে না।

প্রকৃতিতে যারা টিকে থাকে তারা সবাই ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকৃতির সেবা করে। একের কাজ অন্যকে দিয়ে হয় না। ঈগলের কাজ শকুন আর শকুনের কাজ ঈগল করতে পারে না। প্রকৃতি থেকে দুর্বল ও রুগ্ণ প্রাণী সরানোই ঈগলের কাজ; আর মৃতদেহ অপসারণ করা হলো শকুনের কাজ। এর মর্মার্থ হলো, একটি পাখি বিলুপ্ত হলে কমপক্ষে একটি বিশিষ্ট সেবা থেকে প্রকৃতি বঞ্চিত হয়।

প্রকৃতি বারবার বঞ্চিত হলে শেষমেশ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীতে প্রাণের পিরামিডের একেবারে চূড়ায় মানুষের ঠাঁই হয়েছে বলে নিচ থেকে আঘাতটা আসতে সময় লাগে। কিন্তু পুঞ্জীভূত হতে হতে আঘাতটা যখন আসে তখন ক্ষতি একটু বেশিই হয়।

অনেকে মনে করেন, শিকার বন্ধ হলেই পাখি রক্ষা পাবে। শিকার অবশ্যই পাখি ধ্বংসের একটা বড় কারণ। কিন্তু এ দেশে শিকার ছাড়া পাখির আর কোনো বড় হুমকি নেই, এ কথাও ঠিক নয়। আমাদের ভুললে চলবে না যে, আহারের ও বসবাসের স্থান বেদখল হলেও পাখি উৎখাত হয়।

ভূমি-সংকটের এই দেশে প্রতিনিয়ত আমরা পাখির জমি দখল করে নিচ্ছি। জলজ উদ্ভিদে ঢাকা যেসব ডোবায় এককালে ডাহুক পরিবারের বাস ছিল তা পরিষ্কার করে এখন চিংড়ি-পুকুর বানানো হয়েছে। চুন ও ইউরিয়া দিয়ে সাইজ করা উন্মুক্ত পুকুরে ডাহুকের টিকে থাকার কথা নয়।

ডাহুকের মতোই উৎখাত হয়ে যাচ্ছে দল-পিপি। পদ্মে ভরা যে সব প্রাচীন বিলে দল-পিপির বসবাস ছিল তা সেচ দিয়ে চাষের জমি বানানো হয়েছে। পদ্ম পাতার ওপরে হেঁটে জলজ পোকামাকড় খেয়ে টিকে ছিল এই পাখি। কিন্তু আজকের সংকীর্ণ অথবা শুকনো এবং জনাকীর্ণ বিলে দল-পিপির আর স্থান নেই।

একই কাহিনি নেউ-পিপি, কোড়া ও আরও অনেক জলচর পাখির জীবনে ঘটেছে এ দেশে। বংশ পরম্পরায় এরা যে জলাশয়ে বসবাস করত আমরা তা সব পরিবর্তন করে ফেলছি। সারাদেশে এ পাখিদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।

আহারের স্থান যৎসামান্য থাকলেও প্রজননের জায়গা নেই বলে অনেক পাখি এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী যে তিন প্রজাতির হাঁস আছে তার দুটির অবস্থাই এখন সঙ্গিন। এদের নাম দেশি মেটেহাঁস এবং ধলা বালিহাঁস। হাওর-বাঁওড়-বিলে এখনও টিকে থাকলেও এই হাঁসের সংখ্যা কমতে কমতে শূন্যের কাছে চলে গেছে। এর কারণ, এদের প্রজননের জন্য নিরাপদ জায়গা নেই।

দেশি মেটেহাঁস মাটিতে ডিম পাড়ে। আট-দশটি ডিম পেড়ে, ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে এর এক মাস সময় লাগে। জলাশয়ের পাড়ে এক মাস একটি হাঁস নির্বিঘে মাটিতে বসে থাকতে পারবে এমন জায়গা কি আর আছে এ দেশে! রাখাল, জেলে, ঘাস-কাটুয়া, পাতা-কুড়–নি, কৌতূহলী কিশোর, গৃহপালিত পশু, লাওয়ারিশ কুকুর-বিড়াল কত শত্রু আছে হাঁসের। ডিম ফুটিয়ে ছানা নিয়ে পানিতে নেমে যাওয়ার ভাগ্য তাই কম হাঁসেরই হয় এ দেশে।
ধলা বালিহাঁসের কাহিনিটি আরও করুণ। গাছের কোটরে অথবা নির্জন দালান-কোঠার ফোকরে এরা ডিম পাড়ে। শতবর্ষী গাছেই সচরাচর হাঁসের বাসা বাঁধার মতো বড় কোটর থাকে। এমন গাছ এ দেশে ক’টি আছে! নির্জন দালান-কোঠাই বা কোথায়!

নাগালের মধ্যে ছানা পালার উপযুক্ত জলাশয় না পেলে কোটর অথবা ফোকর থাকলেও হাঁসের কাজ হয় না। ডিম ফোটা-মাত্র লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে ছানার দলকে জলাশয়ের সন্ধানে হাঁটা দিতে হয়। নিরাপদ জলাশয়ে দেড়-মাস টিকে থাকতে পারলে তবে এরা উড়ে পালানোর ক্ষমতা অর্জন করে।

প্রাচীন বৃক্ষ-শোভিত নির্জন জলাশয় একদা এ দেশে অনেক ছিল। তখন এখানে লাখ লাখ ধলা বালিহাঁসও ছিল। এখন টিকে আছে কয়েকশ বালিহাঁস, যারা প্রজননের কোনো সুযোগ পায় না। তাই এদের আয়ু শেষ হলে এ দেশে আর কোনো ধলা বালিহাঁস থাকবে না।

আমরা সবচেয়ে বেশি পাখি ধ্বংস করি রাসায়নিক কীটনাশক দিয়ে। কীটনাশক না দিয়ে এখন আর আমরা শস্যক্ষেত, ফল-বাগান কিংবা ফুলের উদ্যান করতে পারি না। রাসায়নিক কীটনাশক মাত্রেই বিষ এবং এর অতি প্রয়োগের ফলে দেশে কীটপতঙ্গের বংশ প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। বাতির পাশে এককালে পোকার যে কু-লী দেখতে পেতেন এখন কি তার এক-শতাংশও দেখা যায়? মাটি, পানি অথবা পাছপালা, যে দিকেই তাকান, কোথাও কোনো পোকা দেখতে পাবেন না।

পোকাই হলো সত্তর শতাংশ পাখির প্রধান আহার্য। পোকার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মূর্খের মতো সর্বত্র পোকা নিয়ন্ত্রণ করে আমরা পাখির বিলুপ্তি ত্বরান্বিত করছি। বাতাসি, সুইচোরা, কাঠঠোকরা, কুটিপ্যাঁচা, রাতচরা ও পাপিয়ার মতো অনেক পোকাভুক পাখি এ দেশে প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে।

ভালোবেসেও আমরা পাখির সর্বনাশ করতে পারি। ভালোবাসি বলেই আমরা বাজার থেকে বুনোপাখি কিনে খাঁচায় পুরে তা পালতে চেষ্টা করি। এর ফলাফল পাখি ও তার প্রতিপালক, দুজনের জন্যই বিয়োগান্ত হয়ে থাকে। দু-এক বছরের মধ্যেই এসব পাখির মৃত্যু হয়।

পাখি ভালোবাসে বলে গ্রামীণ শিশু-কিশোররা পাখির বাসা থেকে ছানা ছিনিয়ে এনে ঘরে পালার চেষ্টা করে। ছানাগুলো সবই অপুষ্টিতে, রোগ-শোকে অথবা দুর্ঘটনায় মারা পড়ে। প্রতি গ্রামে এভাবে মাত্র বিশটি ছানা মারা গেলেও প্রতি বছর এ দেশে দশ লক্ষ পাখি ধ্বংস হয়। অথচ না বুঝে অভিভাবকেরা এ কাজে শিশুদের বাধা তো দেনই না, অনেক সময় সহযোগিতাও করেন।

বুনোপাখি পালার চরম ক্ষতিকর একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। ময়না পাখি পোষা এদেশে খুব জনপ্রিয় একটি শখ। লোকের ধারণা, ময়না পাখি কথা বলে। আসলে বলে না। বলতে পারলে তো স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আমাদের যাচ্ছে-তাই গালাগাল দিত। ময়না পাখি আশপাশের নানা শব্দ নকল করার প্রয়াস নেয়। সেই তুচ্ছ প্রয়াসটুকুই মূর্খ মানুষের বিনোদনের কাজে লাগে। তবে, এ বিনোদন একটা মরীচিকা মাত্র। অধিকাংশ ময়নাই শব্দ নকল করতে শেখার আগেই অক্কা পায়।

নকলনবিশ হতে পারলেও খাঁচার জীবনের একাকিত্ব ও র্বোডম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ময়না পাখি প্রতিদিন হয়তো মৃত্যু কামনা করে। সে আকাক্সক্ষা পূরণ হতেও দেরি হয় না।

আমাদের এই শখটির জন্য এ দেশের বন থেকে ময়না একেবারে উজাড় হয়ে গেছে। এখন উচ্চমূল্য দিয়ে বাজার থেকে যে ময়না আমরা কিনে আনি তা ইন্ডিয়া থেকে চোরাচালান হয়ে এসেছে।

আমরা সবাই চাই এ দেশ পাখিহীন না হোক। কিন্তু সে জন্য কোথাও এক ইঞ্চি ছাড় দিতে আমরা রাজি নই। আমরা চাই এ দেশের সব জমিনে আবাদ হোক, সব জলাশয়ে মাছ চাষ চলুক, সর্বত্র কীটনাশক স্প্রে হোক এবং কংক্রিট ও বিটুমেন দিয়ে দেশটা ছেয়ে যাক। এর বিনিময়ে ষোলো কোটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, বিনোদন ইত্যাদির ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু যদি করা যায়।

আমরা ভাবী, প্রকৃতির দফা-রফা করার পর যদি পাখি থাকে তো ভালো। আর যদি না থাকে তো আমরা তা নিয়ে সভা-সমিতি ডাকব। যথারীতি বিলাপ করব। এতেও যদি প্রকৃতি খুশি না হয় তো আমরা আর কী করতে পারি!
পাখি একেবারে যে নেই তা-ও তো নয়! কাক, চিল, শালিক তো প্রচুর রয়েছে। কোথায় কোনো শকুন কিংবা বুনোহাঁস বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে কি আমরা মানুষের চাহিদাকে গৌণ জ্ঞান করব!

আসলে পাখির প্রতি দয়াপরবশ হয়ে আমরা পাখি সংরক্ষণের কথা বলি না। মানুষের স্বার্থেই পাখি সংরক্ষণের কথা বলি। পাখির ক্ষতি হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় বলেই মানুষের ভালো-মন্দের কথা উঠে পড়ে। একের পর এক পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেলে অবশেষে আমাদেরই বিলুপ্তির দিন ঘনিয়ে আসবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর