চাপের মুখেও ধৈর্য রাখবে বিএনপি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নির্বাচন সামনে রেখে নানা দিক থেকে চাপের মুখে আছে বিএনপি। কিন্তু তা সত্ত্বেও দলটি উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করার কৌশল নিয়েছে। তাদের লক্ষ্য একটাই—আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সে কারণে অন্য কোনো ইস্যুতে ‘হঠকারী’ আন্দোলন করে পরিস্থিতি প্রতিকূলে নিতে চাইছে না দলটি।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ড. কামাল হোসেন যে ভূমিকা রেখেছেন তাতে খুশি হয়েছেন তারেক রহমানসহ বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিককে বলেন, ‘কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ড. কামাল হোসেন সঠিকভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষ করে নির্বাচনে জয়লাভ করলে সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা কে—এ দুটি প্রশ্নের চমৎকারভাবে তিনি জবাব দিয়েছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোশাররফ বলেন, ‘বিএনপির লক্ষ্য নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই আন্দোলন। কিন্তু সরকার আমাদের সভা-সমাবেশ আটকে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চাইছে। আমরাও ধৈর্যের পরীক্ষায় আছি। সময় মতো সব কিছুর জবাব দেওয়া হবে।’

বিএনপি যাতে নির্বাচনে না যায় তেমন পরিস্থিতি তৈরি করতেই দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিককালে ‘গায়েবি’ মামলা দেওয়ার কারণও বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া ঠেকানো। আর সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া উদ্দেশ্য হলো বিএনপিকে আগাম আন্দোলনে নামানো, যাতে সহিংসতাকে কেন্দ্র করে মামলা দিয়ে দলটিকে পঙ্গু করা যায়। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মূল্যায়নও এমনই।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিককে বলেন, ‘সরকার নানাভাবে উসকানি দিয়ে আমাদের মাঠে নামাতে চাইছে। এ জন্যই দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার সময় এবং ২১ আগস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিএনপি ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য হলো—নিরপেক্ষ সরকারের অধীন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায় করা। বিএনপি সেই পথেই আছে।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলার যে কৌশল বিএনপি নিয়েছে, সেটাই অব্যাহত রাখা উচিত। তিনি বলেন, “সরকার নানাভাবে বিএনপিকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিএনপিকে নার্ভ ঠিক রেখে চলতে হবে। কারণ এটা হচ্ছে ‘ওয়ার অব নার্ভ’। এটাই এখন তাদের পরীক্ষা।” এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ড. কামাল হোসেন অনেক বিভ্রান্তি দূর করে দিয়েছেন। কারণ ফ্রন্টের নেতৃত্ব নিয়ে কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছে।

গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণার সময় থেকেই এর নেতৃত্ব নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। কারণ ফ্রন্ট ঘোষণার ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ড. কামাল হোসেন। ওই সময় সুলতান মোহম্মদ মনসুরসহ উপস্থিত কয়েকজন নেতা তাঁকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহম্মদের সঙ্গে তুলনা করেন। পরে ফ্রন্টের আরো কয়েক নেতা সাংবাদিকদের জানান, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বেই ফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। এতে বিএনপিসহ ফ্রন্টের অন্য দলগুলোর মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এ কারণে গত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর ফ্রন্টের বৈঠকে প্রসঙ্গটি আলোচনায় ওঠে।

এদিকে ফ্রন্টের নেতৃত্ব ড. কামাল হোসেনের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঐক্যপ্রক্রিয়ার দু-এক নেতার ভূমিকা নিয়েও কথা ওঠে বিএনপি, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের মধ্যে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখানোর বদলে বিএনপি ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ড. কামাল নিজেই বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কোনো একক নেতৃত্বে নয়, যৌথ নেতৃত্বে চলছে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিককে বলেন, ‘সংবিধান প্রণেতা হিসেবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণ আরো সহজতর হবে বলে মনে করি। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁর ভূমিকা আমাদের আরো আশাবাদী করে তুলেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মান্না বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার অন্যতম উপাদান হচ্ছে সহনশীলতা, যেটি গত কয়েক বছরে বিএনপি প্রচুর পরিমাণে দেখিয়েছে। এখন সরকারি দলকেও এই চর্চার প্রমাণ দিতে হবে, নতুবা রাজনীতিতে সহিংসতা দেখা দেবে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগামী ২৩ অক্টোবর সিলেটে, ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামে এবং ৩০ অক্টোবর রাজশাহীতে সমাবেশ করতে চায়। সিলেটে মেয়র আরিফুল হকের মাধ্যমে বিএনপি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে জানা যায়। প্রথমে অনুমতি দেওয়া হলেও পরে স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ২৩ অক্টোবর একই স্থানে স্বেচ্ছাসেবক লীগ সমাবেশের জন্য আবেদন করেছে। ফলে প্রশাসন অনুমতি দিলে ঐক্যফ্রন্ট ২৪ অক্টোবর সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ২৪ তারিখও না দেওয়া হলে সে ক্ষেত্রে মনে করা হবে, সরকার ওই সমাবেশ করতে বাধা দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ ফ্রন্ট নেতারা সিলেটে মাজার জিয়ারত করতে হলেও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একইভাবে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে সমাবেশের বিষয়েও সরকারের মনোভাব দেখে বিএনপি পরবর্তী কৌশল ঠিক করবে। এর আগে দেশের সুধীসমাজ ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে জনমত গড়ার চেষ্টা করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। আর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করা হবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই। তার আগে আন্দোলন করে শক্তি ক্ষয় করতে রাজি নয় তারা।

জানা যায়, এমন কৌশলের কারণেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার পরও বড় ধরনের আন্দোলনে যায়নি বিএনপি। গত বছর একটি দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পরও বড় ধরনের আন্দোলনে যায়নি দলটি। তারেকের সাজা হওয়ার পরে সহিংসতা হবে, এমন গুঞ্জন ১০ অক্টোবরের আগে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও এ নিয়ে কিছু তৎপরতা ছিল। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর কিছু বলা হয়নি। তবে দলের মধ্যে ‘তারেক সমর্থকদের’ তৎপরতা থামাতে সিনিয়র নেতারা একটি কৌশল বের করেন। তারেক রহমানকে তাঁরা ফোন করে বলেন তিনি নিজেই যাতে পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য লন্ডনে বক্তৃতা করেন। সে অনুযায়ী ৯ অক্টোবর লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে তারেক কারো পাতা ফাঁদে পা না দিতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। এভাবেই সহিংসতা এড়াতে সক্ষম হয় বিএনপি। দলটির কৌশল হলো—আন্দোলন হবে নির্বাচনকেন্দ্রিক।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর