জাতীয় সংসদের সাতটি আসনেই বিরোধ চরমে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রায় সবকটি উপজেলায় চরম বিরোধ-দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। উপজেলা পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে এ কোন্দল আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এমন আশঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার এমন অভিযোগও রয়েছে, কোনো কোনো প্রভাবশালী নেতা এই বিরোধ জিইয়ে রেখে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চাইছেন। সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সীতাকুন্ডে গত ২২ সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত পথসভা স্থগিত করতে হয়েছে সংঘর্ষের আশঙ্কায়।

উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এই জেলায় সংসদীয় আসন রয়েছে ৭টি। কিন্তু প্রতিটিতেই কোনো না কোনোভাবে বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধ-কোন্দল যদি আশু সমাধান করা না যায় তাহলে যতই ঐক্যের কথা বলা হোক না কেন, সত্যিকার অর্থে নৌকার পক্ষে সে ঐক্য অনেকটাই অনুপস্থিত দেখা যাচ্ছে। সীতাকুন্ড, মিরসরাই, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সন্দ্বীপ ও ফটিকছড়ি এই ৭টি উপজেলা নিয়ে গঠিত সাংগঠনিক চট্টগ্রাম উত্তর জেলা। এই ৭ উপজেলাতেই ৭টি সংসদীয় আসন রয়েছে। গত ৪ অক্টোবর ফটিকছড়ি উপজেলায় নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত এক পথসভায় মারামারি, মঞ্চ ভাঙচুরসহ দুপক্ষের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের উপস্থিতিতেই মারামারি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ফটিকছড়ির নানুপুর ইউনিয়নের আজাদী বাজার, নাজিরহাটের ঝংকার মোড়, বিবিরহাট, ভুজপুর বাজার এবং হেঁয়াকো বাজারে পাঁচটি পথসভা করার ঘোষণা দিয়েছিল উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ। আজাদী বাজারে পথসভা চলাকালে ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরীর অনুসারীদের সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস এম আবু তৈয়বের অনুসারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষ ঘটে। এর আগে নাজিরহাটের ঝংকার মোড়ের পথসভার মঞ্চ ভাঙচুর করা হয়। এ জন্য আবু তৈয়বের অনুসারীদের দায়ী করেন নাজিম উদ্দিন মুহুরীর অনুসারীরা।

এ ছাড়া উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রয়াত সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের পরিবারের সঙ্গে দ্বদ্ব রয়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এম তৌহিদুল আলম বাবুর সঙ্গে বিরোধ রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুল হক ও সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরীর। কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত সীতাকুন্ড উপজেলার আওয়ামী রাজনীতি। সব ধরনের প্রস্তুতি থাকলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সম্ভাব্য সংঘাত আর সংঘর্ষের আশঙ্কায় গত ২২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় প্রচার টিমের পথসভাও বাতিল করতে হয়েছে।

কয়েকটি ধারায় বিভক্ত সীতাকুন্ড আওয়ামী লীগের গ্রুপিং-কোন্দলের কারণে সংঘাত-সংঘর্ষ লেগেই থাকে। বর্তমান সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের রয়েছে একটি গ্রুপ, অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুনের গ্রুপ এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাকের ভূঁইয়ার নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপও সক্রিয়। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরীর নেতৃত্বে রয়েছে আরেক গ্রুপ। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় তারা ৪ জনও রয়েছেন। সদ্বীপের এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব আছে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান মাস্টার শাহজাহান বিএর। তারা দুজন একমঞ্চে বসে দলীয় কর্মসূচি পালন করলেও বিরোধ মেটেনি। এ বিরোধে যুক্ত আছেন সন্দ্বীপের মেয়র জাফরুল্লাহ টিটুও। হাটহাজারীতে দলের উত্তর জেলার সাধারণ সম্পাদক এম এ সালামের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আছে যুগ্ম সম্পাদক ইউনুস গনি চৌধুরীর।

রাঙ্গুনিয়ায় কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বর্তমান এমপি ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ওসমান গণি চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী শাহর। আগামী নির্বাচনে ৩ জনই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন। এদিকে রাউজানে পর পর তিনবারের সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিমের সঙ্গে রাউজান পৌর মেয়র দেবাশীষ পালিতের বিরোধ প্রকাশ্য। সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার রোটনের সঙ্গেও রয়েছে ফজলে করিমের দ্বদ্ব। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে ফজলে করিমের বিপরীতে মাঠে রয়েছেন রোটন।

মিরসরাইতে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে তীব্র বিরোধ আছে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলার সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। এ বিরোধের কারণে উত্তর জেলা কমিটিতে প্রথমে যথাযথ পদ পাননি গিয়াস। পরে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে তাকে সহসভাপতি করা হয়। উত্তর জেলার অন্যান্য পদে থাকা ব্যক্তিরা বিরোধে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ে। কোন্দলের কারণে বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উত্তরের ৭টির মধ্যে কেবল মিরসরাইয়েই চেয়ারম্যান পদে জেতেনি আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে তৎকালীন চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিনকে দলীয় সমর্থন না দিয়ে দেয়া হয়েছিল মন্ত্রীর অনুসারী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমানকে। গিয়াস উদ্দিনও প্রার্থী হন। ফলে নির্বাচনে জয় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন গিয়াস। আর আতাউর রহমান হন তৃতীয়।

বিরোধ-কোন্দল রয়েছে সহযোগী সংগঠনের মধ্যেও। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একাধিক হাতবোমা বিস্ফোরণ ও দুটি পক্ষের মারামারির কারণে পন্ড হয়ে যায় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন। চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়িার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে গণপূর্তমন্ত্রী মাইকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। এতে উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একপর্যায়ে সম্মেলনের বাইরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে।

তবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম বলেন, ‘যেসব এলাকায় টুকটাক সমস্যা আছে তা নিরসনে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। নির্বাচনের জন্য আমরা প্রস্তুত। বড় দল হিসেবে নির্বাচনে অনেকেই মনোনয়ন চাইতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও দলের মনোনয়ন বোর্ড থেকে যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে, তার পক্ষেই সবাই মিলেমিশে কাজ করবে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর