ডিজিটাল বাংলাদেশ: শতাধিক সেবা দোরগোড়ায়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আগে জমির পর্চা তোলার জন্য অফিসে অফিসে ছুটতে হতো, যেতে হতো থানা শহরে। এখন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে তুলে নিয়েছি জমির পর্চা। কোনো ধরনের হয়রানি ও ঘুষ ছাড়া খুব সহজেই এখন পর্চা তোলা যায় অনলাইনের মাধ্যমে। কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর কৈবত্তখালী গ্রামের জলিল সিকদার। শুধু রাজাপুরেই নয়, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে (ইউডিসি) সেবা এখন দেশজুড়ে। বর্তমানে সারা দেশে ৫ হাজার ২৭২টি ডিজিটাল সেন্টারে দেওয়া হচ্ছে অনেক রকম সেবা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করেছিল ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র। সেটিই পর্যায়ক্রমে রূপান্তরিত হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছেও ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দিতে ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে এ ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র। ওই বছরের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয় থেকে এবং নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রশাসক হেলেন ক্লার্ক ভোলা জেলার চর কুকরিমুকরি ইউনিয়ন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন। লক্ষ্য ছিল-এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে আধুনিক ডিজিটাল সেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া, যেন এসব প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের মধ্যে একটি তথ্য ও জ্ঞানভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। হিজলা উপজেলার হারিনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, আগে মানুষ ইউনিয়ন পরিষদে আসত না। ডিজিটাল সেন্টারের কারণে এখন ইউনিয়ন পরিষদই সেবার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আজকাল এসব কত সহজ হয়ে গেছে; সেবা পৌঁছে গেছে জনগণের দোরগোড়ায়।

জানা যায়, দেশের ৪ হাজার ৪৫৪টি ইউনিয়নে ইউডিসি, ৩২৫টি পৌরসভায় পৌর ডিজিটাল সেন্টার (পিডিসি) ও সিটি করপোরেশনে ৪০৭টি নগর ডিজিটাল সেন্টার (সিডিসি) স্থাপন করা হয়েছে। ইউডিসির এটুআই (অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন) সূত্র থেকে জানা গেছে, ইউডিসি থেকে বর্তমানে ১১৬ ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সেবা তালিকায় যুক্ত হয়েছে ই-কমার্স এজেন্ট ব্যাংকিং। এরই মধ্যে ৩ হাজার ইউডিসিতে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হয়েছে। অন্যদিকে ৪৩৮টি ই-কমার্স সাইট যুক্ত হয়েছে ইউডিসিতে। ফলে এখন গ্রামে থেকেই শহরের পণ্য কেনা যাচ্ছে। বছরে সোশ্যাল সেফটিনেটের ৫৪ হাজার কোটি টাকা ইউডিসির মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। বর্তমানে দেশের পাঁচটি জেলায় এ প্রকল্পের পাইলটিং হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ডিজিটাল সেন্টার তৃণমূল সেবার হাব (সংযোগ) হিসেবে গড়ে উঠেছে। ইউনিয়ন পরিষদের পর দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনে ৪০৭টি ডিজিটাল সেন্টার ও ৩২১টি পৌরসভায় ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। আইসিটি ডিভিশন এবং এটুআইয়ের মতে, প্রতি মাসে গড়ে ৪০ লাখ মানুষ এসব কেন্দ্র থেকে সেবা নিচ্ছেন। এটুআইয়ের হিসেবে ডিজিটাল সেন্টার থেকে উদ্যোক্তারা এর মধ্যে আয় করেছেন ১৪০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি পদক্ষেপের কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন জনগণের দোরগোড়ায়। তিনি চেয়েছিলেন জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে। তিনি বলেন, জিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এখন সেই সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এখন মানুষ মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সব ধরনের ডিজিটাল সেবা পেয়ে থাকে। এ জন্য তাদের উপজেলা বা জেলা শহরে যেতে হয় না।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সাংবাদিককে বলেন, ‘ডিজিটালসেবা এখন সারা দেশে দৃশ্যমান হয়েছে; কার্যকর ভূমিকাও পালন করছে। এরই মধ্যে ডিজিটাল সেন্টার তৃণমূলের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিকে যুক্ত করার জন্য এটা একটা হাবে পরিণত হয়েছে। আমার কাছে ডাক বিভাগের পোস্ট ই-সেন্টারগুলো যেমন একটি হাব, তেমনি ইউডিসিগুলোও আমার কাছে হাব। সারা দেশে সাড়ে ৮ হাজার ডিজিটাল পোস্টঅফিসও প্রস্তুত। এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো ইউডিসি ও ডাক বিভাগকে সক্রিয় করা। এখন ডিজিটাল সেবা মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। ভবিষ্যতে সেবাকে মানুষের কাছে যেতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিন বদলের সনদ হিসেবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমদিকে কেউ কেউ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়টিকে ঠিকমতো বিশ্বাস করেননি। উল্টো কারও কারও মনে এ নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বিষয়টিকে আস্থার সঙ্গে নিয়ে এ ঘোষণার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়টি উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং তৃণমূল থেকে উঠে আসা একটি বিষয়। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি মিথ নয়, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

এছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় সরকারি ওয়েবসাইট ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’-এ ৪৩ হাজার দপ্তর এখন সংযুক্ত। এতে যুক্ত হয়েছে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়নের ২৫ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট। এসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অফিসের নানা কার্যক্রম সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর দেশের সব জেলায় জেলা ই-সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। জেলা ই-সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে এরমধ্যে ৮ লক্ষাধিক সেবা প্রদান করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও এটুআই প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে সব রেকর্ড এসএ, সিএস, বিআরএস ও খতিয়ান কপি ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি খতিয়ান ডিজিটালাইজড করা হয়েছে।

সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক, অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সর্টিফিকেট, অনলাইন পরিবেশ ছাড়পত্র, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বয়স যাচাই, বাকপ্রতিবন্ধীদের জন্য টকিং ডিভাইসসহ ১৭০টি উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়নের জন্য এটুআই কাজ করছে। ‘তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি’- এ মূল মন্ত্রকে ধারণ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শিক্ষক কর্তৃক মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি, শিক্ষক বাতায়ন, ই-বুক, মনিটরিং ড্যাশবোর্ড ও ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক নামক মডেলগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে। সহজ উপায়ে কৃষকের কাছে কৃষি সম্প্রসারণ সেবাকে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এটুআই তৈরি করেছে ‘কৃষি পোর্টাল’।

এছাড়া সম্প্রতি যোগ হয়েছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০০৮ সালে যেটি ছিল শুধুই স্বপ্ন, আর আজ সেটা বাস্তবতা। গত ৯ বছরে বাণিজ্যিক ও সরকারি কার্যক্রমের জন্য জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে ২ হাজার ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক কেবল ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার পর্যন্ত দ্রুত গতির ইন্টারনেট নিয়ে যাওয়া হবে।

গণমাধ্যম সহায়িকা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, পিআইবির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ডিজিটাল সেবাগুলো থেকে এ পর্যন্ত ইউনিয়ন সেন্টার থেকে মোট ২৬ কোটি ১৪ লাখ সেবা প্রদান করা হয়েছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে ১১২ ধরনের সেবা প্রদান করে ২৫৭ কোটি টাকা উপার্জন করা হয়। ডিজিটাল রেকর্ডরুমের ডিজিটালাইজড রেকর্ডের সংখ্যা থেকে ১৯ লাখ ৫৭ হাজার, অনলাইন আবেদনের গ্রহণ ১ লাখ ৭২ হাজার এবং আবেদন নিষ্পত্তি ১ লাখ ৬ হাজার, ২৩ হাজার ৩৩১টি মাধ্যমিক ও ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন এবং ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে পাঠদান করা হয়।

এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সাংবাদিককে বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ এক সময় স্বপ্নের মতো মনে হতো। আজ তা বাস্তব। এরই মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ আইসিটি অবকাঠামো সৃষ্টি, শিল্পের বিকাশ, জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করাসহ সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসে শুধু একটি দিনই নয়, একটি নতুন স্বপ্নের যাত্রাও বটে। ওই যাত্রা হলো বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। এদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তথ্যপ্রযুক্তির সময়োপযোগী, কার্যকর ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে ‘রূপকল্প-২০২১’ নামের দীর্ঘমেয়াদি এক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন; দিয়েছিলেন ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নের বাস্তবধর্মী নির্দেশনাও।

জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সারা পৃথিবীতে প্রায় সব দেশ তাদের প্রযুক্তিযজ্ঞ শুরু করেছিল শহর থেকে। ধীরে ধীরে প্রান্তিক পর্যায়ে বিস্তৃত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। আমাদের প্রযুক্তিকেন্দ্রিক যাত্রায় শহর-গ্রামে কোনো বৈষম্য নেই। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আইসিটি ডিভিশন এরই মধ্যে বাংলাদেশের সব জেলা-উপজেলাকে উচ্চগতির ফাইবার অপটিক ক্যাবলের আওতায় এনেছে। ২০১৮ সালের মধ্যে ইউনিয়নগুলোও ফাইবার অপটিক ক্যাবলের আওতায় আসবে। এক কথায় আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, সুলভ মূল্যে নিরাপদ সরকারি  সেবা জনগণের কাছে সহজলভ্য করা এবং তথ্যপ্রযুক্তির আগামীর বিশ্বে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সম্ভব সব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর