দুই বছরে দুই শতাধিক জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত

ক্রমেই দীর্ঘ থেকে হচ্ছে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিদের তালিকা। গত দুই বছরে সারা দেশে ইউপি মেম্বার, ইউপি চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ দুই শতাধিক জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন।

যারা বরখাস্ত হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার আসামি। ভোটকেন্দ্রে আগুন, গাড়িতে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ একাধিক মামলার আসামি তারা।

বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সংশ্লিষ্ট মামলায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সাময়িক বরখাস্তের ‘সাজা’ পাচ্ছেন।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যেকোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (চার্জশিট আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পর পর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।

এ আইনের ধারায় ইতিমধ্যে সারা দেশে ২৩ জন মেয়র, ২৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ১৩ জন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং দেড় শতাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে তাদের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধে নাশকতা আর বোমাবাজির ঘটনায় বহু জনপ্রতিনিকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়।

এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত টানা তিন মাস চলে অবরোধ-হরতালে নাশকতা, বোমাবাজি ও অগ্নিসংযোগের এসব ঘটনার মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের।

এসব মামলায় তদন্ত শেষে পাঁচ শতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পরপরই ওই সব জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে।

এভাবে চার্জশিট গৃহীত হওয়ায় এ পর্যন্ত দুই শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। আরো মামলার চার্জশিট প্রক্রিয়াধীন থাকায় ভবিষ্যতে বরখাস্ত জনপ্রতিনিধির সংখ্যা আরো বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়।

তবে অনেক জনপ্রতিনিধি উচ্চ আদালতে রিট করে তাদের বরখাস্তে স্থগিতাদেশ নিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করেছেন।

এভাবে গণহারে বরখাস্তের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরাও। তারা মনে করছেন, পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক বিবেচনায় হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে চার্জশিট হলেই জনপ্রতিনিধিরা সাময়িক বরখাস্ত হচ্ছেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে মামলার ফলাফল কী হবে, তা কেউ জানে না। আর এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে হতে আরেকটা নির্বাচনের সময় চলে আসে। এ ক্ষেত্রে তাই আইনি বিধানটির অপব্যবহার হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, একদিকে রাজনৈতিকভাবে মামলা দিয়ে বিরোধীপক্ষের জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, অন্যদিকে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট অনেকে মামলা মাথায় নিয়েও মেয়র-কাউন্সিলর নির্বাচিত হচ্ছেন; আবার কারো কারো মামলা প্রত্যাহারও করা হচ্ছে। এটা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে এক ধরনের অকার্যকর করে দিচ্ছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর একজন জনপ্রতিনিধি যদি অপরাধ করেন তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় কেউ চার্জশিটভুক্ত আসামি হলে বরখাস্ত হওয়া মানে ওই এলাকার মানুষকে শাস্তি দেওয়া। এভাবে গণবরখাস্তের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়ছে; স্থানীয় সরকারের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যাকারিতা নষ্ট হচ্ছে; প্রতিষ্ঠানের ভাবমূতি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার আইন পরিবর্তনের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, বরখাস্ত ও গ্রেপ্তারের কারণে জনপ্রতিনিধিরা এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে পারছেন না। আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। এই আইনের পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যদি কোনো জনপ্রতিনিধি অন্যায় কাজ করেন, তাহলে অবশ্যই দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে প্রতিপক্ষ দলের জনপ্রতিনিধিদের হামলা-মামলা বা অন্য কোনো উপায়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তা হবে দুঃখজনক। এতে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস উভয়ই নষ্ট হবে। ব্যাহত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যা ভালো লক্ষণ নয়। এতে নাগরিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ।

বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘সারা দেশেই আমাদের সমর্থিত সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিরা বরখাস্ত হচ্ছেন। ক্ষমতাসীন সরকারের মিথ্যা মামলায় অভিযোগপত্র দিয়ে ইতিমধ্যে দুই শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরো কয়েক শ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু তারা জনগণের সেবা করতে পারছেন না। তাদের জনবিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যই বরখাস্ত করার কৌশল নিয়েছে সরকার। অথচ বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী দল সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব পালন করেছেন।’

তবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘সরকার কোনো জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে নাশকতা কিংবা যেকোনো মামলায় চার্জশিট দাখিল এবং তা আদালতে গৃহীত হয়, তখন সেই জনপ্রতিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে অনেকেই উচ্চ আদালতের দারস্থ হয়ে বরখাস্তের স্থগিতাদেশ নিয়ে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছেন।’

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনবিরোধী এবং বর্তমান আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের যেসব জনপ্রতিনিধি জড়িত ছিলেন, তারাই বেশি বরখাস্ত হচ্ছেন।’

জানা গেছে, বগুড়ায় এ পর্যন্ত ১৫ জন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ছয়জন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন পৌর মেয়র ও দুজন ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছেন।

তাদের মধ্যে হাইকোর্টের আদেশে আবার তিনজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও তিনজন ভাইস চেয়ারম্যান দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন।

বগুড়ায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ অর্ধশতাধিক জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত আতঙ্কে ভুগছেন।

সাতক্ষীরার ৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৪৩ জনই জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত। হত্যা-নাশকতাসহ একাধিক মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেওয়ায় তাঁদের সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

একই অভিযোগে কলারোয়ার পৌর মেয়র আক্তারুল ইসলাম ও শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আব্দুল বারীকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ৪৫ জন জনপ্রতিনিধিকে এ পর্যন্ত বরখাস্ত করা হয়।

এর মধ্যে ১৮ জনপ্রতিনিধি গ্রেপ্তার এড়াতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা, হত্যা ও নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে।

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগীখালী ইউপি চেয়ারম্যান পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম সহিংসতা ও নাশকতার মামলায় চার্জশিট হওয়ায় বরখাস্ত হয়েছেন। রবিউল বলেন, ‘কলারোয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলাসহ সহিংসতা ও বিস্ফোরক আইনে আমার নামে কয়েকটি মিথ্যা মামলার চার্জশিট হওয়ায় আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত দেড় বছরে তিনবার জেলের ঘানি টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন জামিনে আছি। আমার মতো জেলার ৪৩ জন ইউপি চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’

সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে পুলিশ একটি হত্যা মামলা দেয়। সেই মামলার কারণে বরখাস্ত হয়েছি। একইভাবে কলারোয়া পৌর মেয়র আক্তারুল ইসলাম, শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আব্দুল বারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে সরকার আমাদের জনবিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করছে।’

আশাশুনি উপজেলার কাদাকাটি ইউপি চেয়ারম্যান মফিজুল হক বলেন, ‘মামলায় পড়ে জেল খেটে জামিন নিয়ে এখন বাইরে আছি। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে খাতির করে এলাকায় আছি।’

বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান বলেন, অন্যায়ভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সমর্থিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে চার্জশিটের কারণে বরখাস্তও হচ্ছেন তারা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বরখাস্তের পর ভারপ্রাপ্ত দিয়ে এসব উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ চলছে। ফলে সার্বিক কর্মকাণ্ডে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এতে হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া জেলায় ১৮ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অস্ত্র, নাশকতা, ভাঙচুর, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। আদালতে চার্জশিট দাখিলের কারণে এঁদের মধ্যে দুজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

গত মহাজোট সরকারের সময় অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়ররা নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে তিনজন সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তারা হলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান। আরিফুল হক ও মান্নান কারাগারে আছেন। সিলেটের মেয়রকে বরখাস্ত করা হয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ার পর। মান্নানকে বরখাস্ত করা হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে।

একই অভিযোগে বরখাস্ত রাজশাহীর মেয়র বুলবুলও। তিনি এখন আছেন আত্মগোপনে। অন্যদিকে বরিশাল সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামালের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুর্নীতি মামলা দায়ের করা হয়েছে। চার্জশিট দেওয়া হয়েছে খুলনা সিটি মেয়র মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় তারা দুজন বরখাস্তের আতঙ্কে আছেন বলে জানা গেছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর