হজের সফর : কয়েকটি জরুরি বিষয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হজের সফর শুরু হয়ে গেছে। সারা বিশ্ব থেকে মুসলমানরা দলে দলে হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় সফর করছেন। আমাদের বাংলাদেশ থেকেও হাজীরা রওনা করেছেন। বাহ্যত এ সফর বেশ কষ্টের। এখানে কায়িক ও আর্থিক নানারকম কষ্টের ব্যাপার থাকে। তবে মনে রাখতে হবে, এই সফর অন্য আর ১০টা দুনিয়াবি সফরের মতো নয়। দেশ-বিদেশ ভ্রমণের মতো কোনো ভ্রমণও নয়। কষ্ট করে, অর্থ খরচ করে দামি হোটেলে থেকে মক্কা-মদিনা ঘুরে দেখার মতোও কোনো সফর নয়। এ সফর অত্যন্ত পবিত্র ও মহিমান্বিত একটি সফর। এই সফর তাকওয়া ও ইখলাস নিয়ে শুদ্ধচিত্তে ঘরে ফেরার সফর।

অথচ আমরা এ মহান সফরেও অপরাধমূলক এমন সব কাজ করে ফেলি, যা সাধারণ সময়েও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে এই সফর থেকে আমাদের যতটুকু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভয় অর্জন করার কথা থাকে, ততটুকু অর্জন করতে পারি না। দোয়া ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে সময়কে কাজে লাগিয়ে সব গোনাহ থেকে পাক-সাফ হয়ে সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানের মতো পূতঃপবিত্র হওয়ার সুযোগটিও আমরা এই সফরে নষ্ট করি। জীবনের গতি পাল্টে ফেলে নিজেকে আল্লাহমুখী করার সহজ পথ থেকে আমরা বিচ্যুত হই। মোটকথা, এই পবিত্রতম সফরের সামান্য প্রভাবও আমাদের জীবনে পড়ে না। এখানে আমরা তাই এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব হজের সফরে যা পালন করলে অথবা পরিহার করলে আমাদের সাধের এই সফরটি হয়ে ওঠবে অত্যন্ত শুদ্ধ ও চূড়ান্ত ফলপ্রসূ।

নিয়ত পরিশুদ্ধ করতে হবে। কেননা যে-কোনো আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য নিয়তের শুদ্ধতা একান্ত জরুরি। আর হজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরও গুরুত্ব বহন করে। এ জন্যই রাসুল (সা.) হজের সফরে বারবার বলতেন হে আল্লাহ! এই হজকে আপনি এমন হজ হিসেবে কবুল করুন, যাতে লোকদেখানো ও খ্যাতির কোনো ইচ্ছা না থাকে। (ইবনে মাজাহ : ২১৯০)।

অনেকেই এখানে নামাজের প্রতি যতবান হন না। অর্থাৎ মক্কা বা মদিনায় থাকাকালীন নামাজের প্রতি যতটুকু গুরুত্ব দেন যানবাহনে, বিশেষ করে প্লেনে থাকা অবস্থায় নামাজের প্রতি ততটা গুরুত্ব দেন না। অথচ একটু চেষ্টা ও ইচ্ছা করলেই ওইসব অবস্থায়ও নামাজের প্রতি যতবান হওয়া সহজ। একটি মৌসুমি ফরজ আদায় করতে গিয়ে রোজকার এমন গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আদায়ে অবহেলার সমর্থন ইসলাম কখনও করে না।

মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার সময় কিংবা একেবারে হজের সফর শেষ করে ফেরার সময় অনেকেই ফ্রেশ হতে গিয়ে দাড়ি কামিয়ে ফেলে। বিষয়টা কষ্টের। কারণ এই দাড়ি হচ্ছে রাসুল (সা.) এর অন্যতম এক মহান সুন্নত। রাসুল (সা.) নিজে দাড়ি রেখেছেন এবং অসংখ্য হাদিসে উম্মতকে এই দাড়ি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন ১০টি বিষয় সব নবী ও রাসুলদের সুন্নত। এর মধ্যে গোঁফ ছোট করা ও দাড়ি লম্বা রাখা অন্যতম। (মুসলিম)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন ‘তোমরা গোঁফ কাটো এবং দাড়ি লম্বা করো। আর অগ্নিপূজকদের বিরোধিতা করো।’ (মুসলিম)। আরও অনেক সাহাবি থেকে এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এখন এই নবীর দেশের সফর শেষে যদি আমরা আমাদের নবীর এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সুন্নতের বাহক হতে না পারি তবে আমাদের চেয়ে হতভাগা আর কে আছে!

বর্তমানে ছবি তোলা বা সেলফি একটি মহামারির আকার ধারণ করেছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও যেখানে ওলামায়ে কেরাম ছবি তোলার ব্যাপারে দ্বিমত করেন, সেখানে আজ মানুষ অপ্রয়োজনে-অকারণে ছবি তোলায় ব্যস্ত। এই হজের সফরেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইহরামের কাপড় পরিধান করা থেকে শুরু করে হজের শেষ পর্যন্ত মানুষ সেলফি তুলে থাকে। অথচ এর দ্বারা হজের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না এ ব্যাপারে কারও কোনো ভাবান্তরও হয় না। আরবের প্রখ্যাত মুফতি শায়খ সালেহ আল ফাওজান হাফিজাহুল্লাহু বলেছেন হজের সফরে অযথা ছবি তুললে হজ কবুল না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। কেননা এতে রিয়া বা লোকদেখানোর ইচ্ছা থাকে, যা ইবাদত কবুল হওয়ার অন্তরায়।

অনেকে হজে গিয়ে শপিং করেই তাদের সিংহভাগ সময় কাটিয়ে দেন। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই তারা হজ করতে এসেছেন, না শপিং করতে। সুতরাং এক্ষেত্রে লক্ষ রাখা উচিত শপিংমলে যাওয়া-আসা করেই যেন এই সফরের মহামূল্যবান সময় অতিবাহিত না হয়। বরং অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, অধিক পরিমাণে তাওয়াফ, নফল নামাজ, দরুদ শরিফ পাঠ ইত্যাদি আমলের মাধ্যমেই যেন সজ্জিত হয় আমাদের এই মূল্যবান সময়।

অনেককেই দেখা যায়, হজের সফরে এসে এই পরিমাণ কেনাকাটা করেন যে, ফেরার সময় বিমানে যেই নির্ধারিত পরিমাণ মাল নেওয়ার সুযোগ থাকে পরিমাণে তার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে অনেকেই ঘুষের মতো জঘন্য আশ্রয়ও গ্রহণ করে ফেলেন। অথচ এই ঘুষদান ইসলামে জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত। এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ের ওপরই আল্লাহর লানত। (ইবনে মাজাহ : ২৩১৩)।
সুতরাং একজন হাজীর জন্য কখনও সমীচীন নয় তিনি হজের সফর শেষ করতে না করতেই এমন জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়বেন।

অনেকেই এ মহান সফরে এসেও ধূমপানের মতো ঘৃৃণ্য ও ক্ষতিকর বস্তু পানের অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন না। এমনিভাবে আরও অন্যান্য যে বদঅভ্যাস রয়েছে, যেমন গিবত, ঝগড়া, গালাগাল, চোগলখুরি ইত্যাদিও ছাড়তে পারেন না। অথচ এই সফরটি ছিল নিজেকে পূতঃপবিত্র ও গোনাহমুক্ত রাখার চর্চা করার অপূর্ব এক সুযোগ। মূলত এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা হজের সফরে এসব কাজ থেকে দূরে থাকার আদেশ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ অবধারিত করে নেয়, সে হজের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গোনাহ করবে না এবং ঝগড়াও করবে না। (সূরা বাকারা : ১৯৭)।

সুতরাং এ বদঅভ্যাসগুলো ত্যাগ করার চেষ্টা করতে হবে এবং হজপরবর্তী অবস্থায়ও এসব থেকে বেঁচে থাকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন! আমিন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর