আমার তুরস্কের স্বপ্ন পূরণের গল্প

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের সব স্বপ্নই সত্যি হয় যদি আমরা সাহস করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। প্রথম দিকে আমাদের অনেক স্বপ্নকেই অসম্ভব মনে হয়, কখনও মনে হয় অভাবনীয়; কিন্তু ভবিষ্যৎ যখন ডাক পাঠায়, তখন সেই স্বপ্ন হয়ে ওঠে অনিবার্য।

আমি নাহিদ সুলতানা। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একেবারে শুরু থেকে আমি পড়াশোনা, রেজাল্ট, সহশিক্ষা কার্যক্রম, বিভিন্ন ক্লাবের কর্মকার্তা যুক্ত হওয়া এসব ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলাম। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল দেশের বাইরে পড়াশোনা করার। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর জানলাম, এখান থেকে শিক্ষার্থী বিনিময় প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যাওয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে।

ডিআইইউ ব্যবসায় ও শিক্ষা ক্লাবের এক বন্ধু হঠাৎ একদিন আমাকে জানাল, তুরস্কের মেভলানা বৃত্তির ২০১৭-১৮ সেশনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। এটা শোনার পর আমি দেরি না করে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিসে যোগাযোগ করি। এরপর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস থেকে আমার সব কাগজপত্র তুরস্কে পাঠানো হয় এবং শেষে ড্যাফোডিলের অপর চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমিও নির্বাচিত হই তুরস্কের কারাবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য।


দেশের বাইরে যাওয়ার এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। সংগত কারণে আমি ছিলাম খুবই আবেগাক্রান্ত বা আবেগাপ্লুত। ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ আকাশযাত্রা শেষে যখন ইস্তানবুলে পা রাখলাম, তখন অভূতপূর্ব সুন্দর এক দেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অতঃপর একটা বাসযোগে আমরা কারাবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর শুরু হলো এক নতুন দিন। কারাবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। কী সৌভাগ্যের ব্যাপার! সেখানে পূর্বপরিচিত কয়েকজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, যাদের সঙ্গে ইতঃপূর্বে বাংলাদেশে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল।

চারপাশে পাহাড় আর অনিন্দ্যসুন্দর মসজিদ দিয়ে ঘেরা কারাবুক বিশ্ববিদ্যালয়, যেন এক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। কারাবুকের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন সূর্যোদয় দেখছিলাম আর সুমধুর আজান শুনছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের জগতে আছি, নাকি বাস্তবে!  তুরস্কের বেশ কয়েকটি শহর ঘুরেছি আমি। দেখেছি ঐতিহাসিক ইন্সট্যান্স, সাফরানবুলো, আমাসরা, জঙ্গুলদাগসহ বিভিন্ন জায়গা। এছাড়াও আমি ঘুরতে গিয়েছিলাম বুলেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সেমিস্টারে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান এসেছিলেন কারাবুক ইউনিভার্সিটি পরিদর্শনে। তিনি যখন আমাদের উদ্দেশ করে বলছিলেন, ‘তোমরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ, তোমরা আমাদের গর্বিত করেছ’, তখন আনন্দে বুকটা ভরে উঠেছিল। এই সফরে ড. মোঃ সবুর খানের সঙ্গে আরও ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইমরান হোসেন এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা সৈয়দ রায়হান-উল-ইসলাম।

যা হোক, কয়েকদিন পর কারাবুকে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হলো। কিন্তু প্রধান সমস্যা দেখা দিল ভাষার প্রতিবন্ধকতা। বেশিরভাগ শিক্ষকই তুর্কি ভাষায় পড়াচ্ছিলেন। ফলে ক্লাসের পড়া বোঝা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তবে শিক্ষকরা এতই আন্তরিক ছিলেন যে, তারা ক্লাসের বাইরেও আমাদের আলাদাভাবে সময় দিতেন। এরই মধ্যে আমি  বেশকিছু তুর্কি ভাষা শিখে ফেলি। এখন তুরস্কের দোকানদারদের সঙ্গে দামদরও করতে পারি!

কারাবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আমি রোমানিয়া, পাকিস্তান, ভারত, কাজাখস্তান, মিশর ও জর্ডানের বেশ কয়জন বন্ধু পেয়েছি। তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছি। আমরা সবাই মিলে ইস্টারসানডে উদযাপন করেছি এবং বাংলা নববর্ষও পালন করেছি। সেদিন আমরা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী শাড়ি পরেছিলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের শাড়ি দেখে অন্য দেশের বন্ধুরা বিস্মিত হয়েছিল।

তুর্কিদের আতিথেয়তা মুগ্ধ করার মতো। আমি কখনও ভাবিনি এই জায়গার প্রেমে পড়ে যাব। তুর্কিদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। বিদেশি মানুষের ভালোবাসা, একা একা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করা, বৃহৎ পরিসরে নিজেকে তুলে ধরা এসব অভিজ্ঞতা ভেতরের শক্তি ও সামর্থ্যকে আমার সামনে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে। আমি নিজের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পেরেছি।

আমি কারাবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষার্থীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘কুলবিস উৎসব’-এ অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের ৫৩ দেশের ৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরে। ওইদিন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের সামনে নিজ দেশের সংস্কৃতি ও ঐহিত্য তুলে ধরতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছিল। আমাদের স্টলে সেদিন বিরিয়ানি রান্না করেছিলাম। আমাদের বিরিয়ানি খেয়ে রেক্টর অধ্যাপক ড. রেফিক পোলাত ও অন্যান্য শিক্ষক বলছিলেন, আবার যদি আমরা বিরিয়ানি রান্না করি তবে যেন তাদের নিমন্ত্রণ জানাই। তারা বাংলাদেশে আসারও আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমাদের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি দেখে আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছবি তুলেছেন। এই দলে ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদস্যরাও। তারা আমাদের খাদ্য সংস্কৃতি ও ঐহিত্য দারুণ পছন্দ করেছেন। শিক্ষার্থী বিনিময় প্রোগ্রামের এটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় সার্থকতা।

আমি উচ্চশিক্ষার জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকে বেছে নিয়েছি। কারণ আমি জানতাম, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনেক সুযোগসুবিধা দিয়ে থাকে। এজন্য আমি ড্যাফোডিলের কাছে চিরঋণী। কারবুকে এসে আমি বিভিন্ন দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জেনেছি। পরিচিত হতে পেরেছি অনেক নতুন মানুষের সঙ্গে।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও কারাবুক ইউনিভার্সিটি একটি পরিবারের মতো। আমি মনে করি, এই সম্পর্ক আমি ভবিষ্যতেও ধরে রাখতে পারব। এই সুযোগ প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও আমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি ধন্যবাদ জানাই ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের প্রতি এবং সর্বোপরি কৃতজ্ঞতা জানাই মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি।

নাহিদ সুলতানা শিক্ষার্থী ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বর্তমানে তুরস্ক সরকারের মেভলানা বৃত্তি নিয়ে কারাবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর