ঐতিহ্যের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস

২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে পাসকৃত ২৮নং আইন বলে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। তবে বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেনি। এই বিদ্যাপীঠের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। পাঠশালা থেকে যাত্রা শুরু করে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে। ১৮৫৮ সালে দীননাথ সেন, ব্রজসুন্দর মিত্র, অনাথবন্ধু মলি্লক, পার্বতীচরণ রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের পরিবর্তিত রূপই আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শিক্ষার ক্ষেত্রে সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই বিদ্যাপীঠের নামকরণ করে একে স্কুলে উন্নীত করলে এ বিদ্যাপীঠ নতুন মাত্রা পায়।

 

জগন্নাথ স্কুল ১৮৮৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং ১৯০৭-৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজের মর্যাদা লাভ করে। ১৮৮৭ সালে স্কুল ও কলেজ শাখাকে পৃথক করে স্কুল শাখাকে ‘কিশোরী লাল জুবিলী স্কুল’ এবং কলেজ শাখাকে ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ’ নামকরণ করে আলাদা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে এর ধারাবাহিক সাফল্য অব্যাহত থাকে। আর এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২০ সালে ইলিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাস করলে এই কলেজের মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যায়। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজকে অবনমন করা হয় এবং ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট’ পাসের মাধ্যমে ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ নামকরণ করে এর স্নাতক পর্যায়ে পাঠদানের ক্ষমতা রহিত করা হয়। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে জগন্নাথ কলেজ অবকাঠামো, ছাত্র-শিক্ষক ও গ্রন্থাগারের বই প্রদান করলে পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে এর মর্যদা বহুগুণে বেড়ে যায়।

১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে নারীরা এই কলেজ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ লাভ করে। তবে ১৯৬৭ সালের আগে কোনো নারী জগন্নাথে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হননি। ওই বছর হামিদা রহমান প্রথম নারী শিক্ষক হিসেবে জগন্নাথ কলেজে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে এই বিদ্যাপীঠকে সরকারিকরণ করা হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সাল থেকেই এই বিদ্যাপীঠে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। যা অদ্যাবধি চালু রয়েছে। ২০০৫ সালে জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হলেও ২০১২ সালে ২৭/৪ ধারা নামক কালো আইন বাতিলের মাধ্যমে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। বর্তমানে ৩১টি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউটে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী এই বিদ্যাপীঠে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পুরান ঢাকার শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেনি। এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যমজ বোন’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ ছিলেন এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র। ২১ ফেব্রুয়ারি রফিকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৪৪ ধারা ভেঙে এগিয়ে গিয়েছিলেন এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র নেয়ামাল বাসির, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলীসহ আরও অনেকে। আর ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় গ্রেফতার হয়েছিলেন এই বিদ্যাপীঠের অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, শিক্ষার্থী মসিহুর রহমান প্রমুখ। এই বিদ্যাপীঠের আরেক ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানও জগন্নাথের হোস্টেলে মাইক্রোফোন ভাড়া করে নিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে গণআন্দোলন গড়তে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়েও এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা শহরকে নাড়িয়ে দিয়েছিল এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জগবাবুর পাঠশালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসিয়েছিল। তারা এই বিদ্যাপীঠে স্থাপিত ক্যাম্পে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণীদের ধরে এনে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। বহু নিরীহ মানুষকেও হত্যা করা হয়েছিল এখানে। মুক্তিযুদ্ধের পর তাই জগন্নাথেই দুটি গণকবর আবিষ্কৃৃত হয়। যদিও বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের ছাত্র-শিক্ষকদের অবদানও ছিল অবিস্মরণীয়। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বহু ছাত্র-শিক্ষক যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। গেরিলা যুদ্ধের নায়ক শহীদ রুমীর সহযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু (নাট্য ব্যক্তিত্ব) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। আরও ছিলেন বিএনপি নেতা সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা।

এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন বীরবিক্রম খেতাব। গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবুল কালাম আজাদকে তার নারিন্দার বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আল বদরের দল। তিনি আজও ফিরে আসেননি। শহীদদের তালিকায় নাম লিখেছেন এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ভোল্ট চ্যাম্পিয়ন মেরাজউদ্দিন।

ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় ও খেলাধুলায় এগিয়েছিল এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য অঙ্গনের পরিচিত মুখের অনেকেই ছিলেন এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী। জগন্নাথের ক্যাম্পাসেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ১৯০২ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, জগন্নাথ কলেজে বাইস্কোপ দেখার জন্য ঢাকাবাসীকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই বিজ্ঞাপনটি তৎকালীন সময়ে এই বিদ্যাপীঠের উচ্চ সাংস্কৃতিক চর্চার বড় প্রমাণ।

ক্রীড়ার ক্ষেত্রেও এগিয়েছিল এই বিদ্যাপীঠ। ঢাকার মাঠের সব ‘এ’ ডিভিশনের খেলোয়াড় দিয়ে ভরা ছিল এই বিদ্যাপীঠের ক্রীড়া টিম। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, আন্তঃকলেজে ধারাবাহিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন ছাড়াও শিক্ষার্থীরা জয় করেছিল রোনাল্ডসে শিল্ড, স্যার এ এফ রহমান শিল্ড, ফিরোজ নূন কাপ প্রভৃতি।

পরিশেষে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে আগামী দিনের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি।

মো. আবু সালেহ সেকেন্দার

সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর