স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর শিক্ষা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাসুল (সা.) হাদিসে কুদসিতে বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বনি আদমকে অনেকগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো, ‘যেদিন আমি (আল্লাহ) অসুস্থ ছিলাম সেদিন তুমি আমার চিকিৎসা ও সেবা করনি? মানুষ বলবে, হে আল্লাহ আপনি কীভাবে অসুস্থ ছিলেন? প্রতি উত্তরে আল্লাহ বলবেন, তোমার প্রতিবেশী কি অসুস্থ ছিল না? তাকে সেবা ও চিকিৎসা করলে আমারই সেবা ও চিকিৎসা করা হতো। (বোখারি)

গেল ৭ এপ্রিল ৭০তম বারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) উদ্যোগে পালিত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০১৮। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল টহরাবৎংধষ ঐবধষঃয ঈড়াবৎধমব : ঊাবৎুড়হব, ঊািবৎুযিবৎব। এ সংস্থার জরিপে বর্তমান বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে অক্ষম। যেখানে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমায় বাস করে, সেখানে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা যে অত্যন্ত কঠিন তা অনুমেয়। এহেন পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে সব মহল। তবুও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার এ আয়োজন সাধুবাদযোগ্য।

ইসলাম পরিপূর্ণ দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে জীবনের প্রত্যেক পরিস্থিতি সম্পর্কে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলামের যাবতীয় শিক্ষার মূল উৎস  কোরআন ও হাদিস। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর এ জীবনাদর্শ যাকে আমরা হাদিস ও সুন্নাহ হিসেবে জানি তা মূলত কোরআনের প্রায়োগিক রূপ। তাই তো রাসুলের আদর্শই সবার জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ। (সূরা আহজাব : ২২)। মানুষের আবশ্যিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিধান এবং তা নিশ্চিতকল্পে তাই তাঁর দিকনির্দেশনা যেমনি কার্যকর, তেমনি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিধানকে দুইভাবে নিশ্চিত করেছেন। ১. নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং ২. অন্যের স্বাস্থ্যও নিশ্চিত করা। সে কারণে, দুইটি উপায়ের কথা তাঁর বাণীতে ও জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। যথা ১. রোগের প্রতিরোধ ও ২. রোগের প্রতিকার।

একটি সাধারণ প্রবাদ হচ্ছে, ‘রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।’ রোগের প্রতিরোধ বলতে যেসব কারণে রোগ হয় সেসব থেকে নিজে এবং অন্যকে মুক্ত রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ১. পাক-পবিত্র (পরিচ্ছন্ন) থাকা। এ বিষয়টিকে তিনি ঈমানের অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অধিকাংশ রোগের মূল কারণ হলো অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন থাকা। পরিচ্ছনতার বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে পরিস্থিতি বিবেচনায় ওজু ও গোসলকে ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। ২. খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া। খাবার গ্রহণের ব্যাপারে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা স্বাস্থ্য রক্ষার সঠিক ব্যবস্থা হিসেবে আধুনিক বিজ্ঞান স্বীকার করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের পেটকে তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ খাবার, অন্য ভাগ পানি এবং বাকি অংশ খালি রাখ এবং ৩. অশ্লীলতা ও পাপাচার ছেড়ে দেওয়া।

মানুষের রোগের অন্য একটি কারণ হলো, অশ্লীলতা, ব্যভিচার, সমকামিতা, স্বমেহন ইত্যাদি পাপাচার। এগুলোকে রাসুল (সা.) হারাম (নিষিদ্ধ) এবং শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কারণ এগুলোর মাধ্যমে সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটতে পারে এবং তা মহামারিতে রূপ নিতে পারে। এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া এসবের কারণ কী তা আজ অজানা নয়। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব সংক্রামক মাহমারি ও যন্ত্রণাদায়ক রোগ দেখা দেয় যা তাদের আগের যুগে ছিল না।’ (সুনান ইবনে মাজাহ)।

দ্বিতীয়ত, রোগ যদি একবার আক্রমণ করেও তাহলে তার জন্য আল্লাহর কাছে যেমন দোয়া চাইতে হবে, তেমনি ওষুধ সেবন করা বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া সুন্নত। রাসুল (সা.) নিজে ওষুধ গ্রহণ করেছেন, চিকিৎসা নিয়েছেন এবং তাঁর উম্মতদের তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিজেই এ ব্যাপারে ৫টি পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। ১. হাজামাত বা রক্তমোক্ষণ, ২. লুলুদ বা মুখে ওষুধ ব্যবহার, ৩. সাউত বা নাকে ওষুধ ব্যবহার, ৪. মাসিঈ বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধের ব্যবহার এবং ৫. কাওয়াই বা লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ার মাধ্যমে আহত অঙ্গের চিকিৎসা করা। এসব পদ্ধতি আধুনিক যুগে প্রয়োগকৃত মূল চারটি পদ্ধতির সমন্বিত রূপও বলা যেতে পারে। যেখানে ডায়াগনসিস, ওষুধ, থেরাপি এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এসবের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর চিকিৎসা বিধানে মধু ও কালোজিরাকে মৃত্যু ছাড়া সব রোগের ওষুধ বিবেচনা করা হতো। ইমাম ইবনু কাইয়ুম আল-জাওজি (রহ.) এর ‘তিব্বু নববি’ নামের বইতে রাসুল (সা.) এর চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষদ আলোচনা স্থান পেয়েছে।

এসব চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অর্থের প্রয়োজন। সেখানে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের পক্ষে সে ব্যয় বহন করার সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) এর শিক্ষা হলো, অসামর্থ্যবান এসব অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা রাষ্ট্র, সামর্থ্যবান আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রতিবেশীরা করবেন। এটি ধনীদের প্রতি তাদের অধিকারও।
রাসুল (সা.) হাদিসে কুদসিতে বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বনি আদমকে অনেকগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো, ‘যেদিন আমি (আল্লাহ) অসুস্থ ছিলাম সেদিন তুমি আমার চিকিৎসা ও সেবা করনি? মানুষ বলবে, হে আল্লাহ আপনি কীভাবে অসুস্থ ছিলেন? প্রতি উত্তরে আল্লাহ বলবেন, তোমার প্রতিবেশী কি অসুস্থ ছিল না? তাকে সেবা ও চিকিৎসা করলে আমারই সেবা ও চিকিৎসা করা হতো।’ (বোখারি)। এই মূল শিক্ষাটি যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারতাম তাহলে বিনা চিকিৎসায় কাউকে মৃতবরণ করতে হতো না। সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মানুষগুলোর আকুতি ও কান্নার শব্দ শুনতে হতো না আমাদের।

পৃথিবীতে অর্থের অভাব নেই যে, এত মানুষের চিকিৎসা করা যাবে না। অর্থের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে পারলে এবং নিজেদের মধ্যে মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে পারলে কখনোই এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাদের হতে হতো না। আজকের বিশ্বে সেরা ২০ জন ধনী ব্যক্তির কাছে সম্পদের বিবেচনায় নিচের দিকে থাকা ২৫০ কোটি মানুষের সমান সম্পত্তি ও অর্থের মালিক তারা। ‘তোমাদের (ধনীর) সম্পত্তিতে বঞ্চিত ও যাচ্ঞাকারীর (গরিবের) অধিকার রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত : ১৯)। কিংবা ‘উদরপূর্ণ ব্যক্তির ইবাদাত কবুল হবে না যদি তার প্রতিবেশী অভুক্ত অবস্থায় থাকে।’ (মুসলিম)। এসব শিক্ষাকে নিজেদের জীবনের বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা একটি সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান সুখী সমাজ দেখতে পারতাম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর