সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক

কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের টিউশন ফি’র উপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে একে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। শিক্ষা যেহেতু কোন পণ্য নয়, তাই এক্ষেত্রে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের আরও ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন ছিল। তবে, প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আগে নিলে এই কয়দিনে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হতো না বলে মনে করেন তারা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের পরিপক্কতার অভাব ছিল বলেও মনে করেন তারা। ভ্যাট প্রত্যাহার নিয়ে গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ অর্থমন্ত্রীকেও দায়ী করে বলেছেন এর দায় দায়িত্ব তিনি নেবেন কি-না? কার্যক্ষেত্রে তাকে আরও পরিপক্কতার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। গতকাল মানবজমিনকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ভ্যাট আরোপের সরকারের সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। নীতিগতভাবেও এটি ছিল একটি অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত। সরকার এখন তা প্রত্যাহার করেছে। এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে, তা প্রত্যাহার করবে এ সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত ছিলাম। প্রত্যাহার না করে উপায়ও ছিল না। এই ভ্যাট আরোপের ফলে একজন শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হতো সে সম্পর্কে হয়তো সংশ্লিষ্টদের তেমন কোন ধারণাই ছিল না। তিনি বলেন, শিক্ষাতো কোন পণ্য নয়, এটি একটি অধিকার। এর মধ্যে ভ্যাট আরোপ করতে হবে কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, ভ্যাট প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তটি খুব উদ্যোগ, মহতী উদ্যোগ। আগামী দিনে দেশের শিক্ষার সমপ্রসারণে এটি ভার ভূমিকা রাখবে। এজন্য আমি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আর কাউকে নয়। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। তাদের ভর্তি হতে হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এদের অনেকেই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাই ভ্যাট প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তে মধ্যবিত্তকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক হলেও এটি আগে নিলে ভাল হতো। তাহলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শিকার হতে হতো না। বিষয়টি এতদূর গড়ানোরও কথা ছিল না। এখন এই কয়দিনে যে ভোগান্তি হলো তার দায় দায়িত্ব কে নেবে? আমার মনে হয় সিদ্ধান্তটি নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের পরিপক্কতার অভাব ছিল। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আদৌ নেয়ার প্রয়োজন ছিল না। তিনি বলেন, আরেকটি নতুন বিষয় হলো, আগে বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতো। এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও শিখে গেল যে আন্দোলন করে রাস্তা অচল করে যে কোন দাবি-দাওয়া আদায় করা যায়। ভবিষ্যতে তারা এ সুবিধা নিতে চাইবে। ছোটখাটো বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবে। রাস্তা অচল করে দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়াবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকার বা অর্থমন্ত্রীর কোন ব্যর্থতা ছিল কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ব্যর্থতা আছেতো বটেই। এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর পরিপক্কতারও অভাব ছিল বলে আমার মনে হয়। তিনি বার বার একই ভুল করছেন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তিনি শিক্ষকদেরও ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। এ সবের পরেও উনিতো দায়িত্ব নিচ্ছেন না।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী ভ্যাট প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। এর মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। শিক্ষা যে একটি অধিকার কোন ব্যবসা নয়, এটিও প্রমাণিত হলো। তিনি বলেন, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী একটি সরকার যে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারে। এটিও হয়তো সে ধরনের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। এর পিছনে যৌক্তিকতাও হয়তো আছে। সরকার হয়তো ভেবেছিল অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু বাণিজ্যে লিপ্ত তাই তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। এ কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে, কোন সহিংস ঘটনা ছাড়াই হওয়ায় বিষয়টির সুন্দর সমাধান হয়েছে। এটি স্বস্তিদায়ক। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের কাছে নিবেদন থাকবে তারাও যেন শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ বা পণ্য হিসেবে না দেখেন। আর নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ তারা বেশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। কোন সহিংসতামূলক ঘটনায় তারা ঘটায়নি। তাদের কাছে আমাদের ইতিবাচক প্রত্যাশা আছে। তারা এমন কিছু করবে না যাতে দেশের অকল্যাণ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তটি সুচিন্তিত ছিল না। ২০১০ সালের শিক্ষানীতির যে মূল চিন্তা সেটার বাইরে চলে গিয়েছিল এই ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত। তাই এর প্রত্যাহারও অবধারিত ছিল। তাই এটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। তবে, এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে কয়েকদিন জনদুর্ভোগ বাড়লো। তিনি বলেন, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তাই ভ্যাট আরোপের মতো এ ধরনের সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজরদারি করলে ভাল হতো। তাদের নজরদারির আওতায় এনে তাদের উপর করের জাল আরোপ করা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীরই প্রতিদিন ১ হাজার টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য নেই। সে ক্ষেত্রে এই ধরনের সিদ্ধান্ত না নেয়াই উচিত ছিল।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর