হাওরে নির্মাণাধীন দেড় হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিফলে যেতে পারে কৃষকদের

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ৩৭টি হাওরের ১২৭টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারের মধ্যে ১২২টিতে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে। বাকি পাঁচটি ক্লোজারে পানি থাকায় ও বাঁধের কাছে মাটি না থাকায় কাজ শেষ হয়নি। ১২২টি ক্লোজারে চলছে বাঁশ ও বস্তা লাগানোর কাজ। স্থানীয় কৃষকদের আশঙ্কা, সময়মতো ক্লোজারের কাজ শেষ না হলে হাওরে নির্মাণাধীন দেড় হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিফলে যেতে পারে। বেড়িবাঁধের যে ভাঙা অংশ দিয়ে হাওরে পানি ঢুকে তাকে ক্লোজার বলা হয়।

স্থানীয়দের কাছে এটি জাঙ্গাল নামে পরিচিত। এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হাওরের পানি একমাস দেরিতে নিষ্কাশন হয়েছে। ফলে নির্ধারিত সময়ের তুলনায় ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণের কাজও অনেক বিলম্বে শুরু হয়েছে। এছাড়া, মাটি কাটার শ্রমিক ও খনন যন্ত্রের সংকটের কারণে কাজ কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল ইসলাম জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের হালির হাওর, ধর্মপাশা উপজেলার জয়ধুনা, ধানকুনিয়া, চন্দ্রসোনার থাল, সোনামোড়ল, গুড়মার হাওরের বেড়িবাঁধ ও ক্লোজার পরিদর্শন করেছেন।

সুনামগঞ্জ পনি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জেলার অন্যতম শনি হাওর, মহালিয়ার হাওর, পাগনার হাওর, হালির হাওর, মাটিয়ান হাওর, কাইল্যানীর হাওর, গুরমার হাওর, চন্দ্রসোনারথাল হাওর, সোনামোড়ল হাওর, ছায়ার হাওর, ধানকুনিয়া হাওর, জোয়ালভাঙ্গা হাওরসহ ১২৭টি হাওরে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার রয়েছে। শনির হাওরে ঝুঁকিপূর্ণ ভাঙা (ক্লোজার) রয়েছে বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলায়।

এগুলো হলো রহমতপুরের ভাঙা, নান্টুখালীর ভাঙা, ঝালখালীর ভাঙা, লালুগোয়ালা, নয়াবারুঙ্কা, মাসুকেরখাড়া, বাড়-কড়ি ভাঙা, মহালিয়ার হাওরের  নোয়াগাঁও ক্লোজার ১, নোয়াগাঁও ক্লোজার ২, নোয়াগাঁও ক্লোজার ৩, পাগনার হাওরের মুচিবাড়ি, গজারিয়া, মাতির ঢালা, মোড়লপুর ক্লোজার, বোগলাখালী, কাউয়ার বাঁধ, ডালিয়ার ভাঙা, উরারবন্দ, ফুলিয়াটানা, কাইল্যানী, এলনজুড়ি, হালির হাওরের কালাগাঙ্গ ক্লোজার, কোপাগাঙ্গের ভাঙা, লক্ষ্মীপুরের ভাঙা, ডাকাতখালী, কালিবাড়ি, হেরাকান্দি, মাহমুদপুরের ক্লোজার, গন্নিয়ার খালের ভাঙা, সাচনার খালের ভাঙা, মাতিয়ান হাওরের আলমখালী, মেশিনবাড়ি, টাকাটুকি গাজিপুর, পাঁচনালিয়ার ভাঙা, বড়দলের ভাঙা, কাউকান্দি ভাঙা, ছিলাইন তাহিরপুরের ভাঙা, ধরুন ভাঙা, নাইন্দার ভাঙা, মাঝের খাল ভাঙা, গুরমার হাওরের গলগলিয়া, বাগমারা, জয়জুর, কাইল্যানীর হাওরের টঙ্গিবাঁধ, শাহপুরের ভাঙা, কইঝুরা, নরসিংহপুর, ঘোড়াডোবা হাওরের ফুলদোয়ারী, জমশদপুর, আখরা, শাইল্যানী, সোনামোড়ল হাওরের কুকুরমারা, রাজনার ভিটা, হাতিমারা, জারাকোনা, কয়রানী, চন্দ্রসোনার থাল হাওরের শয়তানখালী ভাঙা, মাদারিয়া ভাঙা, উলাষখালী, আলীপুরের ভাঙা, মিলনপুরের ভাঙা, গাগলাখালী ভাঙা ও চাঁনপুরের ভাঙা।

 ধানকুনিয়া হাওরের নূরপুরের ভাঙা, ইন্দু রাজারঢালা, মোহিনিপুরের ঢালা, জয়ধুনা হাওরের মুক্তারপুরের ঢালা, টাংনির হাওরের বাদালিয়ার ভাঙা ও ঘোড়ামারার ভাঙা, বরাম হাওরের তুফানখালী, বোয়ালিয়ার ভাঙা, শয়তানখালী, কলাপাড়া, পাখখন্ডরী, উদগল হাওরের মাচুয়া খাড়া, গিলোটিয়ার ভাঙা, কাশিপুর ভাঙা, জয়পুরের ভাঙা, কালিয়াকোটা হাওরের কলকলিয়া ভাঙা, চাপতির হাওরের বৈশাখী ভাঙা, কাশিতলা, খাটশিয়ার ভাঙা, ভেড়াডহর হাওরের কুশিয়ারার ডান তীর, প্রতাপপুর, ফয়জুল্লাপুর, ছায়ার হাওরের মাদারিয়া ভাঙা, শাল্লা ব্রিজের ভাঙা, ভান্ডাবিল হাওরের নোয়া জাঙ্গাইল, হরিনগর,

সাংহাই হাওরের টলাখালীর ভাঙা, কুইড়ার খাড়া, ডেকার হাওরের টলাখালীর ভাঙা, কুইড়ার খাড়া, করিমপুর ভাঙা, দিগদাইর ভাঙা, উথারিয়া ভাঙা, কাচিভাঙা হাওরের ভাইবোনের ভাঙা, খাই হাওরের পাখিমারা ভাঙা, রাঙ্গামাটির ভাঙা, জামখোলা হাওরের দরগাপাশা ভাঙা, পূর্ববীরগাঁও ভাঙা, সুরাইয়া বিবিয়ানা হাওরের বালিশ্রীর ভাঙা, নলুয়ার হাওরের বেতাওকার ভাঙা, বোরাখালী, আশারকান্দি, কুশিয়ারার ডান তীর, জোয়ালভাঙা হাওরের নিয়ামতপুর ভাঙা, জিরাকের ভাঙা, করচার হাওরের সোনাপুর ভাঙা, হরিমনের ভাঙা, আঙ্গারুলি হাওরের চন্ডিতলা, গাছতলার ভাঙা, ফুলবরির ভাঙা, পুটিয়ার হাওরের বিরামপুরে ঢালা, পেটফোলা ঢালা, কাঠের ব্রিজের ভাঙা, নাইন্দারে হাওরের মংলার ভাঙা, তেগাঙ্গার ভাঙাসহ মোট ১২৭টি ঝুকিপূর্ণ ভাঙা রয়েছে। ধর্মপাশা উপজেলার জারাকোনা গ্রামের আব্দুল জলিল বলেন, ‘এ বছর হাওরের বাঁধে যে পরিমাণ মাটি দেওয়া হয়েছে তা আর কোনও সময় দেওয়া হয়নি।

তবে জাঙ্গালের কাজ শেষ না হলে বেড়িবাঁধে কোনও কাজ হবে না। কারণ, নদীতে পানি এলে জাঙ্গালে পানির চাপ বাড়ে, তাই দ্রুত জাঙ্গালের কাজ শেষ করা উচিত।’  ইসলামপুর গ্রামের মিয়া চাঁন বলেন, ‘হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ হলো জাঙ্গাল। যা দিয়ে আগাম বন্যার পানি হাওরে প্রবেশ করে। জাঙ্গাল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ স্থান। হাওরে পানি প্রবেশের অন্যতম রাস্তা এটি।’ মধ্যনগর থানার সালদিগা গ্রামের আব্দুস সোবাহান বলেন, ‘প্রতিবছর নদীর পানি বাড়লে জাঙ্গালেও পানির চাপ বাড়ে।

পরে জাঙ্গাল রক্ষার জন্য হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মাটি কাটে। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রনজিত চৌধুরী রাজন বলেন, ‘হাওরের জাঙ্গাল হলো একটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান। আয়তনের দিক থেকে ততটা বড় না হলেও এগুলোতে পানির চাপ বেশি থাকে। তাই জাঙ্গালকে অবহেলা করলে চলবে না। জাঙ্গালে বাঁধ শক্ত মজবুত করার জন্য বাঁশ, বস্তা ইত্যাদি দিতে হয়। কারণ, পানির চাপ বেশি। পানি আসার সঙ্গে হাওরের জাঙ্গালগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, উপজেলার ছোট বড় ২৩ হাওরে ১৪টি জাঙ্গাল (ক্লোজার) রয়েছে। এগুলোর কাজ ৭০/৮০ ভাগ শেষ হয়েছে।

জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনার হাওরের তীরবর্তী ভীমখালী নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক জহির মিয়া বলেন, ‘এ বছর হাওরের পানি দেরিতে নামছে। তাই ধানের ফলনও পিছিয়ে যাবে। একই কারণে বাঁধ নির্মাণকাজও দেরিতে শুরু হয়েছে। ছিলাইন তাহিরপুর গ্রামের সোলেমান বলেন, ‘তড়িঘড়ি করে পানি আইলে গাঁওয়ের হকল মানুষ জাঙ্গালে উড়াকোদাল নিয়ে মাটি কাটন যাওন লাগে। অথচ জাঙ্গালের কাজ এখনও চলছে।’

জামালগঞ্জ উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  উপসহকারী প্রকৌশলী নিহার রঞ্জন দাস বলেন, ‘জামালগঞ্জ উপজেলার ৬টি হাওরে ১২টি ক্লোজার রয়েছে। এগুলোতে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে কিন্তু এখনও বাঁশ বস্তা দেওয়া হয়নি। তবে এগুলোতে হুট করে পানি ঢোকার কোনও আশঙ্কা নেই। তবে হালির হাওরের কালীবাড়ি ক্লোজারের কাজ ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।

বাকি কাজ দুই একদিনের মধ্যে শেষ হবে। ধর্মপাশা উপজেলার হাওরের ফসল রক্ষা বাধের দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘এ উপজেলায় জয়ধুনা, ধানকুনিয়া, চন্দ্রসোনারথাল, গুরমা, কাইলানী, ঘোড়াডোবাসহ ৭টি হাওর রয়েছে। এসব হাওরে ২৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলেছে। এছাড়া, ৭টি হাওরে ৩৪টি ক্লোজার রয়েছে। ক্লোজারগুলোর মাটির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে বাঁশ লাগানো ও বস্তা ফেলার কাজ। যা দুই-একদিনের মধ্যে শেষ হবে।’ জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল ইসলাম সোমবার জয়ধুনা হাওর, সোনামোড়ল হাওর, চন্দ্র সোনার থাল হাওর, ধানকুনিয়া হাওরের বেড়িবাঁধ ও ক্লোজার পরিদর্শন করেছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, এবছর দুই লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা যায়, এবার সুনামগঞ্জের ৫২টি হাওরে ফসল রক্ষায় বাঁধের কাজ হচ্ছে। এজন্য গঠন করা হয়েছে ৯৬৪টি পিআইসি। প্রতিটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে। এ কাজে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২২ কোটি টাকা। অতীতে বাঁধের কাজে কখনও এত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। গত বছর এ বরাদ্দ ছিল ৬৮ কোটি টাকা। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘এবছর প্রাকৃতিক কারণে হাওরের পানি দেরিতে নিষ্কাষন হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসেও সুনামগঞ্জের নদনদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সে সময় অনেক বাঁধ নির্মাণের এলাকা শুকায়নি। ফলে মেজারমেন্ট করতে সমস্যা হয়েছে। তাই নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি।’ ক্লোজারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ ক্লোজারে মাটির কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন বাঁশ ও মাটি ভর্তি বস্তা, চাটাই ফেলার কাজ চলছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’ জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল ইসলাম হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ক্লোজার পরিদর্শন করে বলেন, ‘এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় আলাদা একটি বছর। কারণ, এবছর হাওরের পানি প্রায় এক মাস দেরিতে নিষ্কাষন হয়েছে। হাওরের পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নীতিমালা অনুযায়ী  কাজ  শুরু করেছে।

এখন দ্রুত গতিতে বাঁধ নির্মাণের  কাজ চলছে। তবে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ) গঠন হওয়ার পর আড়াই মাস সময় পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ততটা সময় পায়নি তারা। কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৫ ডিসেম্বর ও শেষ করার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রাকৃতিক কারণে হাওরের পানি দেরিতে নামায় কাজে  ব্যাঘাত ঘটেছে। তারপরও যেভাবে কাজ এগোচ্ছে সে গতি সন্তুষজনক। অধিকাংশ পিআইসির কাজের মান খুবই সন্তোষজনক। এখনও কিছু বাঁধে মাটির কাজ বাকি রয়ে গেছে। আগামী দশ তারিখের মধ্যে সেগুলোও শেষ করা যাবে। জেলা প্রশাসন ও পাউবো এবং পিআইসি সবাই হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজে আন্তরিক। তাই বাঁধ নিয়ে শঙ্কার কোনও কারণ নেই কৃষকদের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর