যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে মুসলমানদের বেশি ভয় পায় ইউরোপ

সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, যারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভ্রমণ ও অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে, তাদের ওপর ভিত্তি করে ন্যাশনালিস্ট পার্টিগুলোর বিজয় সম্ভব কি না? হল্যান্ডের সাংবিধানিক নির্বাচন মধ্য মার্চে হওয়ার কথা; এতে লিডিং পজিশনে আছে মুসলিমবিরোধী গির্ট উইল্ডারের ফ্রিডম পার্টি। উইল্ডার্স এটা সর্বসমক্ষে স্বীকার করেছেন, তিনি মুসলিমদের ঘৃণা করেন না, তবে তাদের ধর্মকে ঘৃণা করেন এবং ‘ইসলামের মতো ভয়ংকর হুমকি’কে অবাধে ছেড়ে রাখার জন্য মূলধারার রাজনীতিকদের যথেষ্ট গালমন্দও করেছেন
জন লয়েড।

সম্প্রতি ইউরোপে পরিচালিত ‘ইসলাম, সন্ত্রাসবাদ এবং ইমিগ্রেশন’ সংক্রান্ত এক জনসমীক্ষায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ইউরোপিয়ানই অধিক মুসলিম অভিবাসনের বিপক্ষে। অর্থাৎ তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মুসলিম অভিবাসন নিষিদ্ধ’ করার পক্ষে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে তা এই মুহূর্তে আদালতের চ্যালেঞ্জের কারণে স্থগিত আছে।

জনসমীক্ষাটিতে ১০টি ইউরোপিয়ান স্টেটের প্রায় ১০ হাজার লোকের মতামত জরিপ করা হয়। ব্রিটিশ সেমিঅফিসিয়াল ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইনস্টিটিউট ‘চ্যাথাম হাউজ’ এ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বিশ্বব্যাপী চলমান বিতর্কিত ইস্যুগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে শীর্ষে রয়েছে ‘মুসলিমদের অভিবাসন নিষিদ্ধ ঘোষণা।’ আর এ ইস্যুতে ইউরোপিয়ান জনগণের চিন্তাধারা ঠিক কী ধরনের, সে সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার লক্ষ্যেই মূলত এ জনসমীক্ষাটি চালানো হয়েছিল।

‘মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে আর কোনো অভিবাসন এই মুহূর্তে বন্ধ করা উচিত’ এ মন্তব্যকে সামনে রেখে চালানো জরিপে দেখা যায়, গড়ে ৫৫ শতাংশ লোকই এর পক্ষে মত দিয়েছেন, ২০ শতাংশ এর বিরুদ্ধে এবং ২৫ শতাংশ লোক পক্ষে বা বিপক্ষে কোনোটাতেই মতামত দেননি। স্পেন এবং যুক্তরাজ্য শুধু এ দুটি দেশেই এ মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণকারী লোকের সংখ্যা সবচেয়ে কম। পোল্যান্ডে এ হার ৭১ শতাংশেরও বেশি, একই হার অস্ট্রিয়া, জার্মানি এবং ইতালিতেও।

যুক্তরাষ্ট্রেও প্রায় একই অবস্থা, তবে সাধারণভাবে ট্রাম্পের ব্যানের পক্ষে জনসমর্থন কিছুটা কম। রয়টার্স আইপিএসওএসের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের নীতির পক্ষে সমর্থন রয়েছে ৪৯ শতাংশ লোকের, আর এর বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন ৪১ শতাংশ লোক। রয়টার্সেও জরিপে এটাও দেখা গেছে যে, ৩১ শতাংশ লোক এ নীতিকে ‘অধিকতর নিরাপদ’ বলে মনে করেন, আর ২৬ শতাংশের দৃষ্টিতে এটি ‘কম নিরাপদ’।

এক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো আমেরিকা শুধু একটি সাময়িক ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করতে চাইছে পলিসি হিসেবে। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের একটি চেষ্টা হলো মুসলিমদের সঙ্গে টেররিস্ট কানেকশন আছে, এমন একটা ব্যাপার প্রতিষ্ঠা করা; কিন্তু ইউরোপিয়ান রাজনৈতিক পার্টিগুলোর হাতে ঠিক এই মতামত প্রতিষ্ঠা করার মতো তেমন কোনো শক্তিশালী ক্ষমতা নেই। ইউরোপের মূলধারার রাজনীতিকরা এখনও সব পলিটিক্যাল পার্টিগুলোকে এ ব্যাপারে একত্রিত করতে পারেনি।

সুতরাং পরিস্থিতি যথেষ্টই জটিল। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট যেহেতু ‘ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা’র ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছে, তাই মার্কিন প্রশাসনকে এখন হয় অধিকতর বড় বিচারক প্যানেল তৈরি করতে হবে অথবা সরাসরি মার্কিন সুপ্রিমকোর্টে আপিল করতে হবে। প্রেসিডেন্টের সিনিয়র কাউন্সিলর ইতোমধ্যে তার এক বক্তব্যে বলে দিয়েছেন, অত্যন্ত অপ্রীতিকর সত্য এই যে, একটা বড় ধরনের যুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে। সেটি এমন এক যুদ্ধ, যা এখনই রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বৈশ্বিক সংঘর্ষের জন্ম দেবে।

পূর্বেকার জরিপগুলোয় দেখা গেছে, ইউরোপে অ্যান্টি-ইমিগ্রেশন মনোভাব সবচেয়ে বেশি অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিতদের মধ্যে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, ধনী, সুপরিচালিত দেশগুলো যাদের ওয়েলফেয়ার স্টেটস আছে, শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশি এবং তুলনামূলকভাবে বেকারত্বের হার নেই বললেই চলে যেমন অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন তাদেরও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মুসলিম কমিউনিটির ইমিগ্রেশন ইস্যু। একইসঙ্গে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মতো অত্যন্ত কম মুসলিম কমিউনিটি সম্পন্ন দেশগুলোতেও এ ইস্যুতে রয়েছে সহিংস মনোভাব।

যদিও ইউরোপের শীর্ষ নেতারা নিকট অতীতেও তাদের ভোটারদের এ ব্যাপারে পুনঃপুন আশ্বস্ত করেছেন যে, ইসলামিস্ট টেররিস্ট আক্রমণে নিহতদের সংখ্যা এখনও তাদের যে-কোনো সাধারণ ‘ব্যাড ডে’র তুলনায় নেহাতই কম, তারপরও এ ব্যাপারে জনমনে আস্থার সৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সাধারণ মানুষ কোনো কমন প্লেসকে ভয় পায় না, তারা ভয় পায় ওই কমিউনিটিকে, যারা অন্যদের থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে এবং যারা মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর পশ্চিমা সেনা আগ্রাসনের কথা বলে নিজেদের সহিংসতাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে।

সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, যারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভ্রমণ ও অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে, তাদের ওপর ভিত্তি করে ন্যাশনালিস্ট পার্টিগুলোর বিজয় সম্ভব কি না? হল্যান্ডের সাংবিধানিক নির্বাচন মধ্য মার্চে হওয়ার কথা; এতে লিডিং পজিশনে আছে মুসলিমবিরোধী গির্ট উইল্ডারের ফ্রিডম পার্টি। উইল্ডার্স এটা সর্বসমক্ষে স্বীকার করেছেন, তিনি মুসলিমদের ঘৃণা করেন না, তবে তাদের ধর্মকে ঘৃণা করেন এবং ‘ইসলামের মতো ভয়ংকর হুমকি’কে অবাধে ছেড়ে রাখার জন্য মূলধারার রাজনীতিকদের যথেষ্ট গালমন্দও করেছেন। ডেনমার্কে গত সেপ্টেম্বরে হাদেরসেভ নামক বন্দর নগরীতে ‘অ্যান্টিমাইগ্রেন্ট’ এর লিফলেটও বিলি করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর