আজানের দোয়া : বিতর্ক ও সমাধান

হাওর বার্তা ডেস্কঃ শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) প্রণীত ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’র আজানের দোয়ায় ‘ওয়াদ্দারাজাতার রাফিয়া’ অংশটি মজুদ রয়েছে। (খ–২, পৃ. ১৯৫; মাকতাবা থানভী, দেওবন্দ, ভারত)। গ্রন্থটির লেখক হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) এ উপমহাদেশের সব শ্রেণির ওলামা-মাশায়েখ, ফুকাহা ও মুহাদ্দিসিনের মূল ওস্তাদ। তাই তার মতো মনীষীর অংশটি উল্লেখ করাই এটির সত্যতা ও যথার্থতার প্রমাণ বহন করে

আজানের দোয়ায় বেশ কয়েকটি বাক্যের সঙ্গে ‘ওয়াদ্দারাজাতার রাফিয়া’ ও ‘ওয়ারজুকনা শাফায়াতাহু ইয়াওমাল কিয়ামাহ’ অংশটি পাঠ করা হতো। এখন অনেকে পাঠ করেন না। প্রশ্ন হলো, এই অংশটি হাদিসে আছে কি না বা তা পাঠ করা যাবে কি না? শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) প্রণীত ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’র আজানের দোয়ায় ‘ওয়াদ্দারাজাতার রাফিয়া’ অংশটি মজুদ রয়েছে। (খ–২, পৃ. ১৯৫; মাকতাবা থানভী, দেওবন্দ, ভারত)। গ্রন্থটির লেখক হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) এ উপমহাদেশের সব শ্রেণির ওলামা-মাশায়েখ, ফুকাহা ও মুহাদ্দিসিনের মূল ওস্তাদ। তাই তার মতো মনীষীর অংশটি উল্লেখ করাই এটির সত্যতা ও যথার্থতার প্রমাণ বহন করে।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) রচিত গ্রন্থে আজানের আলোচ্য দোয়াটি যে হাদিসখানায় উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বাক্যাংশটি রয়েছে এভাবে ‘কিয়ামত দিবসে আমাদের তাঁর শাফায়াত নসিব করুন বা তার শাফায়াতের অন্তর্ভুক্ত করুন।’ (খ–৫, পৃ. ১২৪; দারু এহইয়াউত তুরাছিল, বৈরুত, লেবানন)। ‘আততারগিব ওয়াত-তারফহব’ গ্রন্থে  এতদসংক্রান্ত হাদিসগুলোর ৩নং হাদিসে বিভিন্ন প্রামাণ্য উৎস উল্লেখ করে গ্রন্থকার বলছেন, বায়হাকিতে ‘ইন্নাকা লা-তুখলিফুল মি’য়াদ’ অংশটি অতিরিক্ত উদ্ধৃত হয়েছে।’ (হাফিজ জাকীউদ্দিন আবদুল আযীম আল-মুনযিরী (রহ.), খ- ১, পৃ. ২১৫; ইফা)। হাদিস নং ১১-এ বিবৃত হয়েছে যে, নবীজি (সা.) আজানের শেষে নিজে আলোচ্য দোয়াটি পড়েছেন এবং তারপর এরশাদ করেছেন, যারা ওই দোয়াটি বাক্যসহ পড়বে কেয়ামতের দিন তাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৮)। হাদিস নং ১৩ এর উদ্ধৃতিতেও বাক্যটি স্থান পেয়েছে। অবশ্য এ হাদিসে আবার মূল দোয়াটি ভিন্ন বাক্য ও ভিন্ন আঙ্গিকেও স্থান পেয়েছে। (প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৯)। রাদ্দুল মুহতার-শামী ও দুররুল মুখতার এ  বলা হয়েছে, ‘আজান শেষে দরুদ পড়ে প্রিয়নবী (সা.) এর জন্য ‘ওসিলা’-মর্যাদা প্রাপ্তির দোয়া পড়তে হবে। ইবনু হাজার ‘শারহুল মিনহাজ’ গ্রন্থে বলেছে, ‘ওয়াদ্দারাজাতার-রাফিয়া’ বাক্যাংশ এবং পরিশেষে ‘ইয়া আরহামার রাহিমিন’ বাক্য বলে, দোয়াটি শেষ করার কোনো ভিত্তি নেই।’ (খ-১, পৃ. ৩৯৮; এইচএম সাঈদ এডুকেশনাল প্রেস, করাচি)।

আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, একই গ্রন্থের কৃত উর্দু তরজমা ‘গায়াতুল-আওতার’-এ অনুবাদক শামীর বরাতে উল্লেখ করেছেন, একই অবস্থা ‘ওয়ারজুকনা শাফায়াতাহু’ বাক্যটিরও। (১ম খ-, পৃ. নং ২০০ ও ২০১৯)। (অর্থাৎ এটিরও কোনো ভিত্তি নেই বা এটি হাদিসের অংশ নয়)। অথচ মূল গ্রন্থে আল্লামা শামী (রহ.) তা বলেননি।
মোটকথা, আল্লামা শামী (রহ.) ও উর্দু তরজমাকারীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, হাদিসে বর্ণিত দোয়ার অংশ হিসেবে আলোচ্য বাক্যাংশ দুটি প্রমাণিত নয়। কিন্তু ওই অংশ দুটি যোগে আজানের দোয়া পড়া যাবে কি যাবে না, সে বিষয়ে এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হচ্ছে না। তার কারণ, শরিয়া বিষয়ে সিদ্ধান্তদানের নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘ফিকাহ-ফতোয়া গ্রন্থাদিতে উদ্ধৃত সব কথা/বক্তব্য/উদ্ধৃতি, আমলের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিধানরূপে পরিগণিত হয় না।’ সুতরাং আল্লামা শামীর ও ‘গায়াতুল-আওতার’ এর অনুবাদকের উল্লিখিত মন্তব্য এক্ষেত্রে পালনযোগ্য বিধানরূপে গণ্য হবে না।

‘আজানের জবাব দিয়ে আজান শেষে দরুদ পড়ে আলোচ্য দোয়াটি পড়লে পরকালীন বিরাট ফায়দা হবে অর্থাৎ কেয়ামত দিবসে প্রিয় নবীজির (সা.) সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যাবে’ এটি কোনো আইন-আদালতসংক্রান্ত বিষয় নয়, যেখানে হাদিসটি সহি কী গর-সহি তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে; এটি বরং একান্ত ফাজায়েলের প্রসঙ্গ। আর ফাজায়েলসংক্রান্ত ফিকাহ ও হাদিসের উসুল বা মূলনীতিতে বলা হয়েছে, ‘বিশেষজ্ঞরা বলেন, যখন আমরা হালাল-হারামবিষয়ক হাদিস বর্ণনা করি তখন কঠোরভাবে তা যাচাই-বাছাই করি, আর যখন ফাজায়েলবিষয়ক হাদিস বর্ণনা করি তখন কঠোরতা অবলম্বন করি না।’ (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : খ-১, পৃ. ৭৩, ৭৪ ও ৭৫; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)। অর্থাৎ ফাজায়েল বিষয়ে দুর্বল হাদিসও গ্রহণ করা যেতে পারে।

উক্তরূপ হাদিসে আমল করার ক্ষেত্রে তিনটি শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে, যথা ১. মারাত্মক দুর্বল না হওয়া, ২. প্রচলিত কোনো মূলনীতির আওতায় পড়া ও ৩. আমলের ক্ষেত্রে তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত বলে বিশ্বাস পোষণ না করা। (তাদরিবুর রাবী : পৃ. নং ১৯৬)। আমাদের আলোচ্য শাফায়াতবিষয়ক হাদিসগুলো ওই তিন শর্ত ও নীতিমালার মধ্যেই রয়েছে। আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহ.) জাল হাদিস চিহ্নিত করার তিনটি উপায় উল্লেখ করেছেন যথা ১. হাদিসটি যুক্তি-বুদ্ধির বিপরীত হবে বা ২. অন্য হাদিসের বিরুদ্ধে হবে, ৩. মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।’ (তাদরিব : পৃ. ১৮০)। আমাদের আলোচ্যশাফায়াত প্রার্থনা বিষয়টি যুক্তিবিরোধীও নয়; অন্য হাদিসবিরোধীও নয় এবং ফিকাহ ও হাদিস শাস্ত্রের কোনো নীতি-মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিকও নয়, সুতরাং জাল-ভেজালের প্রশ্নই আসে না। আমরা পরবর্তী সংখ্যায় বিষয়টির আরও বিশ্লেষণ করব।

লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর