পদ্মা-যমুনার নদীর সংযোগকারী বড়ালের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পদ্মা-যমুনা নদীর সংযোগ রক্ষাকারী চলনবিলের প্রাণ বড়াল নদীর অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা নদী বড়ালের উৎপত্তিস্থল। বড়াল বেসিন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের নামে প্রবাহমান এই নদীটিকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। বড়াল নদী রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ২০৪ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়ে বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জে যমুনায় মিশেছে। বড়াল হচ্ছে চলনবিলের প্রধান নদী বা প্রাণ। বড়াল শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলের ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাড়ি প্রায় পানিশুন্য হয়ে পড়েছে। এর বিরুপ প্রভাবে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বানিজ্য, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি খাত মারাত্মক হুমকীর মুখে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে নৌ যোগাযোগ। আবহাওয়ায় বিরাজ করছে মরু রুক্ষতা।

পদ্মা এবং যমুনার পানি যখন বাড়ে বড়াল নদী হয়ে সেই পানি প্রবেশ করে চলনবিলে। এতে বিল চালু থাকে। সে কারণেই বিলটির নামকরণ করা হয় ‘চলনবিল’। এই বিলের পানি সর্বদাই চলমান। চলনবিলের অভ্যন্তরে অসংখ্য ছোট-বড় বিল ও খাল রয়েছে। এসব বিল ও খাল প্রাকৃতিক। আবার বিল থেকে ছোট নদীর উৎপত্তি হয়েছে। নদী থেকে খাল হয়েছে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, চলনবিলের প্রাণ বড়াল নদীতে পানি প্রবাহ না থাকার কারণে শুকিয়ে গেছে নন্দকুজা, মুসা খাঁ, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতি, গুমানী, আত্রাই, ফুলঝোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, গোহালা নদী, ছয়আনি বিল, বাঁইড়ার বিল, সাধুগাড়ী বিল, সাঁতৈল বিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ার বিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ী বিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়ি বিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়ি বিল, খৈগাড়ি বিল, বৃগরিলা বিল, দিগদাড়িয়া বিল, খুলুগাড়ি বিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ার বিল, ধলার বিল, ধরইল বিল, বড়বিলা, বালোয়া বিল, আমদাকুরী বিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরী বিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরাবিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়া বিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণের বিল, নলুয়াকান্দি বিল, ঘরগ্রামবিল, বেরল বিল, কচিয়ার বিল, কাশিয়ার বিল, কাতল বিল, বাঘমারা বিল, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়া বিল, আইড়মারী বিল, কৈখোলা বিল, কানচগাড়ী বিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গা বিল, মেরীগাছা বিল, খলিশাগাড়ীর বিল, নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, জানিগাছার জোলা। চলনবিলের বিল-নদী-খাড়ী শুকিয়ে জেগে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃর্ণ সমতল ভূমি। হারিয়ে যাচ্ছে জলজ গুল্মলতা ও জীববৈচিত্র, বেড়েছে আর্সেনিকের মাত্রা। আবহাওয়ায় বিরাজ করছে মরু রুক্ষতা।

বড়াল নদীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। রাজশাহীর চারঘাট থেকে জন্ম নিয়ে বড়াল নদী নাটোরের গুরুদাসপুরের কাছে আত্রাই নদীতে মিশেছে। এই অংশকে আপার বড়াল বলা হয়। এই অংশের দৈর্ঘ্য ৮৪ কিলোমিটার। বড়াইগ্রামের আটঘড়ি থেকে বেড়িয়ে বনপাড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সাঁথিয়া হয়ে শাহাজাদপুরের বাঘাবাড়ী ঘারে ভাটিতে চয়ড়ায় হুড়াসাগর নদের সাথে মিলিত হয়ে যমুনা নদীতে মিশেছে। এই অংশ লোয়ার বড়াল নামে পরিচিত। লোয়ার বড়ালের দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। বড়াল নদীর মোট অববাহিকা হচ্ছে এক হাজার ৫৪২ বর্গকিলোমিটার। আপার বড়ালের গড় প্রস্ত ৬০ মিটার, গড় গভীরতা ৫ মিটার। লোয়ার বড়ালে গড় প্রস্ত ১২০ মিটার, গভীরতা ৯ দশমিক ৯০ মিটার।

বড়ালের দুটি শাখা নদী হচ্ছে মুসা খা এবং নন্দকুজা। মুসা খাঁ নদীর উৎপত্তি নাটোরের বাগাতিপাড়া হাপানিয়ায়। পাইকপাড়া গিয়ে মুসা খাঁ নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে নারোদ নদীর।এই নদীটি নন্দকুজা নদী হয়ে আত্রাই নদীতে মিশেছে। বড়ালের একটি প্রশাখা নাগর নদী। এই নদী তীরেই আত্রাই উপজেলার পতিসরের রবিন্দ্র কাছারি বাড়ী। এই নদীকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন  আমাদের ছোট নদীচলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। চলনবিলের মধ্য দিয়েই বড়াল-আত্রাই-নাগর নদী পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুর থেকে পতিসরে এবং পতিসর থেকে নাটোরে যাতায়াত করতেন। বড়ালের শাখা নন্দকুজার উৎপত্তি নাটোরের আটঘড়িতে। নদীটি নাটোর হয়ে গুরুদাসপুরের চাঁচকৈরে আত্রাই নদীর সাথে মিশেছে। নন্দকুজা এবং আত্রাইয়ের মিলিত প্রবাহ গুমানী নাম ধারণ করে চাটমোহরের নুননগরে বড়ালে মিশে বড়াল নামেই বাঘাবাড়ী চলে গেছে। বাঘাবাড়ীর ভাটিতে বড়াল এবং করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুড়াসাগর নাম ধারণ করে ৮ কিলোমিটার ভাটিতে যমুনায় মিলেছে।

চলনবিলের প্রাণ খর বড়াল নদীকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়াল বেসিন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎস্য মুখে নির্মাণ করে তিন দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট। পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বড়াল নদী’র স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করা হয় ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামকস্থানে আরো একটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট নির্মাণ করে। এই গেইটটি নির্মাণের ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তর দিকের অংশে পানি চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুজা অপর ভাগ বড়াল। এখানেই বড়ালের মুখে নির্মাণ করা হয় এক দরজা বিশিষ্ট একটি স্লুইস গেট।

একদিকে বড়ালের উৎস্য মুখে চারঘাটে স্লুইস গেইট, অন্যদিকে দীর্ঘদিন এত বড় একটি নদীর মুখে এক দরজার একটি স্লুইস গেইট নির্মাণ করায় ভাটির বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় নদী অস্তিত্তহীন হয়ে পড়েছে। বনপাড়ার ভাটিতে বড়াল নদীতে তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইস গেইট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুড়া এবং চাটমোহরের দহপাড়ার নিকটে। দহপাড়ার নিকটবর্তী স্লুইস গেইটটির উভয় পার্শ্বই শুকিয়ে যায় শুস্ক মওসুমে। অনেকেই নদী দখল করে ঘর-বাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছে। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করছে।

বড়াল অববাহিকার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সত্তুর দশক পর্যন্ত বড়াল ছিল স্থানীয় যোগাযোগ ও বাণিজ্যের চালিকাশক্তি তেমনি ছিল সংস্কৃতি ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা, বার্জ, জাহাজ, কার্গোজাহাজে পণ্য সামগ্রী আনা-নেয়া হতো বড়াল নদী পথে। চলতো বড় বড় লঞ্চ ও ষ্টিমার। এই অঞ্চলের শতকরা নব্বইভাগ অধিবাসীই ছিল বড়াল নদীর উপর নির্ভরশীল। চারঘাটে স্লুইস গেইট নির্মাণ করার ফলে নদী সংঙ্কুচিত হতে থাকে, পানি প্রবাহ হৃস পায়। এর ফলে পরিবর্তিত হতে থাকে পরিবেশ ও বড়াল পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা। বড়াল অববাহিকার অর্থনীতি মূলত কৃষি, মৎস্য ও গবাদীপশুসম্পদ নির্ভর। ধান, চাল, মসুর, খেসারী, সরিষা, মাসকালাই, পাট প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য বড়াল অববাহিকার সুখ্যাতি ছিল। নৌপথে বড়াল পাড়ের ফসল যেত চাঁদপুর, চট্রগ্রাম, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

বড়ালে যখন পানির প্রবাহ ছিল স্বাভাবিক তখন শুস্ক মওসুমে নদী তীরের জমিতে নদীর পানি পাওয়ার পাম্প দ্বারা সেচ দেয়া হতো। নালা বা খালে পানির প্রবাহ ছিল। তাতে বিলের অভ্যন্তরের জমিতে সেচ দেয়া যেত। নদীতে ক্লোজার নির্মাণ করার পর পানি না থাকায় সেচ হয়েছে শ্যালো বা ডিপ মেশিন নির্ভর। বড়াল নদী অববাহিকায় এখন ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। নদী মরে যাওয়ায় বিরুপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে। চলনবিলের প্রসিদ্ধ মৎস্য সম্পদ হৃস পেয়েছে। হাঁস পালন কমেছে। বিশাল গোচারণভূমিতে আগের মতো মাসকালাই ও খেসারী ঘাস জন্মে না। তাতে গবাদীপশু সম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। শুস্ক মওসুমে বড়ালে পানি প্রবাহ না থাকায় বিল শুকিয়ে যায়। বিলে পানি সঙ্কট দেখা দেয়। চাষী ও মৎস্যজীবীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। জেলে সম্প্রদায় এখন বিলুপ্ত প্রায়। উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত চলনবিলে ৭০ থেকে ৭৫ প্রকার মাছ পাওয়া যেত। এখন তার অনেক প্রজাতিই বিলুপ্তির তালিকায় নাম উঠেছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর