ভেসে গেছে ৭ হাজার পুকুর-জলাশয়ের মাছ

রংপুরে ৭ হাজার পুকুর, বিল, জলাশয়ের মাছ ভেসে গিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে চাষিরা। টানা প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রংপুরে তিস্তা নদীসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার ৮ উপজেলার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। দিশাহারা চাষিদের সংকট উত্তরণে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় রংপুরে দিন দিন মাছ চাষিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সম্ভাবনাময় এ খাত সম্প্রসারণে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগে মৎস্য চাষিদের মাছ চাষে উৎসাহিত করা হয়। জেলার গঙ্গাচড়া, পীরগাছা, কাউনিয়া, সদর, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ, তারাগঞ্জ উপজেলাসহ ৮ উপজেলায় শত শত মাছ চাষি পুকুর, বিল, জলাশয় সরকারি-বেসরকারিভাবে লিজসহ ব্যক্তি উদ্যোগে মাছ চাষ করে আসছিল। এতে বেশ লাভের মুখ দেখছিল তারা। কিন্তু আকস্মিকভাবে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানির তোড়ে ভেসে গেছে কয়েক হাজার টন মাছ। এতে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ক্ষতির কথা জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তর। তবে চাষিরা বলছেন ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। বিশেষ করে ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করে আসা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মৎস্য চাষিদের অনেকেই হয়েছেন সর্বস্বান্ত। গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর মৎসজীবী সমিতির কাছ থেকে লিজ নিয়ে ৩২ জন মৎস্য চাষি খারুভাঁজ বিলে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। তাদের রোজগারেই চলতো পরিবারের ২শ’ সদস্য। ১৭ একরজুড়ে এ বিলে চাষ হতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। আকস্মিক এ বর্ষণে ৫শ মণ মাছ ভেসে যাওয়ায় দুর্দশা নেমে এসেছে এসব পরিবারে। খারুভাঁজ বিলের মৎস্য চাষি মো. বকুল মিয়া (৫৫) জানান, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর এমন ভয়াবহ পানির তোড় প্রথমবার দেখা গেল। এই পানির তোড়েই মাছ ভেসে যাওয়ায় তাদের স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আফসার মিয়া (৬৪) জানান, মাছ চাষ করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করতাম। মাছ ভেসে যাওয়ায় আমাদের পঙ্গু হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। খারুভাঁজ বিলের মাছ চাষিদের মতো একই অবস্থা গঙ্গাচড়া উপজেলার মাছ চাষি রহিম আলী, জোনাব আলী, এরশাদ, মোমতাজ আলী, রাজ্জাক মিয়া, আফসারুল, রাজুর। পানি উপচে পুকুরের পানির উপচে সব মাছ বেরিয়ে গেছে। এতে করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন তারা। কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার খবির উদ্দিন (৬৩) ও মুকুল মিয়া (৫২) জানান, এ উপজেলার ৪ শতাধিক পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ায় নতুন করে এ পেশায় ফিরে আসা নিয়ে সংশয় রয়েছে তাদের। সদর উপজেলার চিকলী বিলের মাছ চাষি রাজু (৩৫) বলেন, প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ বিলে মাছের পোনা ছেড়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। পানিতে সমস্ত বিনিয়োগ ভেস্তে গেছে। সরকারিভাবে সহায়তা না পেলে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। একই অবস্থা জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও। গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম জানান, টানা বর্ষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গঙ্গাচড়া উপজেলার মৎস্যজীবীরা। তাদের এ পেশা টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ প্রেরণ করা হচ্ছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান জানান, টানাবর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে জেলার প্রত্যেক উপজেলা মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে গঙ্গাচড়া, পীরগাছা, কাউনিয়া, মিঠাপুকুর এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানির স্রোতে ভেসে গেছে বিভিন্ন উপজেলার ১০১৭ হেক্টর জমির ৬৪৬৬টি পুকুরের প্রায় ৩ হাজার ৩০ মেট্রিক টন মাছ। যার মূল্যমান প্রায় ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এছাড়া ৪০ লাখ টাকার মাছের পোনার ক্ষতি হয়েছে। পানির স্রোতে ৭৩ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতিসহ এ খাতে মোট প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতির কথা জানান তিনি। তিনি আরও জানান, জাল এবং বানা দিয়ে মাছ রক্ষার জন্য চাষিদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পুকুরে মাছের পোনা মজুত করার ব্যবস্থাসহ বন্যা পরবর্তী মাছের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। মাছ চাষিদের সহযোগিতা করতে ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর