ক্রমহ্রাস পাচ্ছে পৃথিবীর প্রকৃতি ও পানিসম্পদ

বিজ্ঞানের যতই অগ্রগতি হোক অথবা মানুষ যতই প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় আনার চেষ্টা করুক, এখনও পর্যন্ত প্রকৃতিই সর্বশক্তিমান। পানি-প্রকৃতির এমনই এক দান যেটি ছাড়া শুধু মানুষ কেন, দুনিয়ার কোন প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারেনা।

পানি হচ্ছে সেই পদার্থ যা প্রাণ সঞ্চারের জন্য একান্তভাবেই প্রয়োজন। অথচ এই অপরিহার্য এবং একান্ত প্রয়োজনীয় পদার্থটির এখন নানাভাবে অপচয় হচ্ছে, অথবা অযাচিত এবং অপরিকল্পিত ব্যবহারে দূষিত হচ্ছে। পানিসম্পদের এহেন গুরুত্ব বুঝতে না পেরে আমরা তার অযাচিত অপচয় করছি। যদিও পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে আছে পানি, এর ২.৫ শতাংশ হচ্ছে ফ্রেশ ওয়াটার, বাকি পুরোটাই সামুদ্রিক অথবা নোনা পানি। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ড.ঐ.ঙ) এর মতে মানুষের ব্যবহারের জন্য মাত্র ১.০০৭ শতাংশ পানি সুলভ। এর অর্থ, পৃথিবীতে ফ্রেশ ওয়াটারের পরিমান যৎসামান্য। যা দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে। যার বন্টনরীতিতেও সমতা নেই। পানি বা জলবিন্দু একটি হাইড্রোলজিকাল চক্রের অংশ। কিন্তু এই চক্রের বিভিন্ন অংশে পানির গতি ভিন্ন। মানুষের কাজ এই চক্রে বিঘœ ঘটাতে পারে এবং ফ্রেশ ওয়াটারকে দূষিত করতে পাবে। জনসংখ্যা বিস্ফোরন, নগরায়ণ এবং পানি সম্পদের উপর নিরন্তর চাপের ফলে তার পরিমান ক্রমহ্রাস পাচ্ছে।

আমাদের পানি সম্পদকে আমাদেরকেই বাঁচাতে হবে। কারন একমাত্র এভাবেই আমরা নিশ্চিত করতে পারবো আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যত। প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের দায়িত্ব আছে পানি সম্পদকে বাঁচানোর। শুধু সরকারের উপর সব দায়িত্ব দেয়াও সমীচিন নয়। সরকার আসবে, সরকার যাবে। পানি যে আমাদের জরুরী প্রয়োজনের অন্যতম প্রয়োজন। এই দায়িত্ব আমাদের সবার। দূষণমুক্ত পানির জন্য সরকারের উচিত পানিসম্পদ সম্পর্কীত জনগণকে সম্পৃক্ত করে পানি সংরক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা। বিভিন্ন টার্গেট গ্র“পের কাছে পানিসম্পদ সংরক্ষণের গুরুত্ব পৌঁছে দেয়া এবং কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়া। কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য হতে হবে এমন যা প্রতিটি মানুষ উপলব্ধি করতে পারে এই পানি আমার, এটা সংরক্ষণের দায়িত্বও আমার। যেমন যুব সমাজ, মহিলা, শিশু, কৃষক, ক্ষেতমজুর, সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে এই কর্মসূচির সাথে সম্পৃক্ত করে এক সাথে এক আওয়াজ হোক, পানি সংরক্ষণের জন্য আমরাও অনেক কিছু করতে পারি। ইউনিয়ন, গ্রাম মহল্লা থেকে শুরু করে- গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে গ্রাম একই শ্লোগান উঠুক- “মানুষ আমরা ভাই ভাই; সবাই মিলে বাঁচতে চাই, দখলমুক্ত দেশ চাই; দূষণমুক্ত পানি চাই।” সরকারের দায়িত্ব শুধু কথায় নয় কাজে প্রমাণ করা। দূষণমুক্ত প্রকল্প চালু করা; খাল-বিল, নদ-নদী নালার মতো পানি সম্পদকে দূষণমুক্ত রাখা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে উদ্যোগ গ্রহন করা।

ব্যক্তি হিসাবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হই তাহলে আমরা অনেকাংশেই এই সমস্যার মোকাবেলা করতে পারি। যেমন, নিজ নিজ এলাকায় পানি যেন নষ্ট না হয়, তার প্রতি নজর রাখা, রাস্তায় কোন কল বা টিউব-অয়েল থেকে যাতে অকারনে পানি পড়ে অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা এন.জি.ও এবং স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য নিয়ে পানি সংরক্ষণে কাজে লাগাতে পারি। আমাদের দৈনিন্দিন জীবনেও পানিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে আমরা তার অপচয় রোধ করতে পারব। গোসল করার সময় অথবা জামা-কাপড় ধোয়ার সময় পানি যতটা সম্ভব অল্প পরিমানে ব্যবহার করাই ভালো। পানিকে কোন ব্যক্তি বা সংস্থা যদি দূষিত করে তবে সেই ব্যক্তি বা সংস্থাকে উপযুক্ত শাস্তি সহ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা এবং আইনীভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

পানিসম্পদ সংরক্ষণ এবং পানিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- পথ নাটিকা, ডাকটিকেট, ক্যালেন্ডার, টিভি, রেডিও, প্রিন্ট মিডিয়া, ইন্টারনেট, গেস্ট লেকচার, স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচি ইত্যাদি। যুব সমাজ ও শিশুদের সুপেয় পানি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পানির প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব বোঝানো উচিৎ। গৃহকর্মে পানি রিসাইকেল করা, পানিকে দূষণমুক্ত রাখা এবং স্যানিটেশন সম্পর্কে মহিলাদের জানানো প্রয়োজন। কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং অন্যান্য গ্রামবাসীদের ক্ষেত্রে ুগুরুত্ব দেয়া হোক পানিসেচ, পানির উপর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে বন্যা ও খরা রোধ করা এবং ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট এবং ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বিশেষ স্থান পেতে পারে।

একবিংশ শতাব্দীর যাত্রাতেই একদিকে যেমন পানির চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে পানি সম্পদের পরিমান হ্রাস পাচ্ছে। বিগত দশক থেকে কয়েক দফা ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন সাস্টেসেবল ডেভেলপমেন্ট’ এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে সুপেয় পানি সংরক্ষণ ও তার গুণমান বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়। অর্থাৎ পানিসম্পদের স্বল্পতা এখন সারা বিশ্বের কাছেই দুশ্চিন্তার বিষয়। ৮০’র দশকে অনেকগুলো নদীর মধ্যে পরস্পর আন্তসংযোগের ধারনা চালু হয় এবং খাল ও নদী খনন কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। অপরিকল্পিত কর্মসূচি হাতে নেওয়ায় তা আর হয়ে উঠেনি। এখন এ কর্মসূচি সফলভাবে করতে পারলে, এর ফলে যে সকল নদীতে অপর্যাপ্ত পানি ছিল সেই সমস্ত এলাকা থেকে পানি সরবরাহ করা যেত। বাংলাদেশে যেহেতু পানির পরিমান বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের, ফলে এদেশে খাদ্য-খরা-বন্যা-জলোচ্ছাস দেখা যায়। অর্থাৎ কোনও কোনও অঞ্চলে দেখা দেয় খরা-মন্দা। বিভিন্ন অঞ্চলে পানি নিয়ে সমস্যা এমন অবস্থা উপনীত যা অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।

অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে উনবিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত পানির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে সাত থেকে আট গুণ, হিসেবে যেটা দেখা যায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি। ২০২৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বর্তমানের চেয়ে বেশি- দ্বিগুণ হলে, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে পানির চাহিদা- বাড়তেই থাকবে। এর মধ্যে পানির পরিমান ও তার চাহিদা প্রায় সমানের চেয়ে বেশি হয়ে যেতে পারে। তারপর চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের চেয়ে বেশি হবে। সেক্ষেত্রে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে গত দুই দশকে দেশের ১৭টি প্রধান নদী পুরোপুরি মরে গেছে, আরোও ৮টি নদী অল্প সময়ের মধ্যে মরে যাবে। এর মধ্যে এই নদীগুলোর সঙ্গে মূল নদীর সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে। এক কালে খর¯্রােতা নদী হিসেবে পরিচিত হলেও এসব নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে।

শিল্পায়নের যেমন অনেক ভাল দিক আছে তেমনি খারাপ দিকও আছে। এর অন্যতম হল পানিদূষণ। বিভিন্ন শিল্পজাত বর্জপদার্থ পানিকে দূষিত করে। বুড়িগঙ্গা নদী তার অন্যতম উদাহরণ। উন্নতি হলেই হবেনা, তাকে হতে হবে ‘অপ্টিমাম সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’।এর দায়িত্ব নিতে হবে শিল্পপতিদের। শিল্পপতিদের শুধু লাভের কথা ভাবলে চলবেনা। আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্বন্ধে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। কারন, পানিসম্পদ যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে শুধুমাত্র আম-জনতাই নয় তাঁদের জীবনেও এর প্রভাব পড়বে।

পরিশেষে মানুষকে এটাই মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতিই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিজেদের শক্তি আর বুদ্ধিমান ভেবে গর্ববোধ করা এক ধরনের মুর্খতামি ছাড়া কিছুই নয়। উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ও পানিসম্পদকে ধ্বংস করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই।

পেগান সভ্যতা’র যুগের মানুষদের আমরা অশিক্ষিত ও বর্বর বলে জেনে এসেছি, কারণ সেই যুগের মানুষ প্রকৃতিকে ভয় পেত। এজন্যই তারা অগ্নি, জল, বায়ু ইত্যাদিকে পুঁজো করত। কিন্তু আমাদের এই তথাকথিত আধুনিক ও অগ্রসর যুগেও তাদের কাছ থেকে আমরা শিখতে পারি যে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করা আর নিজদে ধ্বংস করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমরা আমাদের আধুনিক বলে দাবি করি। তাহলে আমরা আধুনিক মানুষ কী নিজেদের ধ্বংসের পথ নিজেরাই তৈরি করব ?

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর