হাওর বার্তা ডেস্কঃ পরিযায়ী পাখি ‘বড় ধলাকপাল রাজহাঁস’ এসেছে এমন খবরে গত শুক্রবার পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীতে ট্রলার নিয়ে ঘুরছিলেন এ প্রতিবেদক। হঠাৎ বীজবর্ধন খামার সংলগ্ন এলাকায় নৌকার ওপর বসা এক কিশোরের ওপর কৌতূহলী চোখ আটকে যায়। ছেলেটি বগলে কায়দা করে বৈঠা চেপে ধরে দুই হাতে বই নিয়ে বসে আছে। মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। নদীতে ইলিশ ধরার জাল পাতা।
এই দৃশ্য দেখে ক্যামেরায় দ্রুত কয়েকটি ছবি তুলে কাছে গিয়ে জানা গেল, তার নাম মো. ইউসুফ। বাউফল উপজেলার কর্পূরকাঠী ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সে। শ্রেণিতে ৭৯ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মেধা অনুযায়ী তার রোল নম্বর এক। চমকানোর যা বাকি ছিল, ‘ক্লাস ওয়ান থেকে আমার রোল এক’—এই কথা শোনার পর তা আর বাকি থাকল না। পারিযায়ী পাখির কথা বেমালুম ভুলে ইউসুফের কথা শুনলেন এ প্রতিবেদক।
ছেলেটি ভাসমান মান্তা পরিবারের সন্তান। বাবা মো. ফরিদ উদ্দিন ও মা রুনা লায়না। তাদের স্থায়ী ঠিকানা নেই। তাদের নৌকার বহর পটুয়াখালীর বাউফল ও দশমিনা উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা বগি খালে অবস্থান করছে। তার সম্পর্কে আরো জানতে আধাঘণ্টা নৌকা চালিয়ে যাওয়া হলো বগি খালে। খোঁজ করা হলো তার মা-বাবার।
মান্তারা জানায়, ইউসুফের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাদের নৌকার বহর এই খালে আসে। বগি এলাকার বাসিন্দা মো. হেদায়েত মুন্সি কয়েক বছর আগে ইউসুফ ও অন্য চার শিশুকে স্থানীয় বেসরকারি রাইড অ্যান্ড সাইড ফর চিলড্রেন নামের একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়ে নিয়ে ভর্তি করে দেন। মান্তা পরিবারে অভাব নিত্যসঙ্গী। তারা নদীতে মাছ ধরাকে লাভজনক মনে করে। তাই অন্যরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে গেছে। কিন্তু ইউসুফ সেই ধারা ভেঙেছে। ধরে রেখেছে বিদ্যালয়ের পড়াশোনা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বাউফল উপজেলার নারাইনপুর খাল, কালাইয়া খাল, হোগলা খাল, তালতলী খাল, গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া খাল, পক্ষিয়া খাল, চরকাজল খাল, বোয়ালিয়া খাল, পানপট্টি খাল, বদনাতলী খাল, রামনাবাদ খাল, পাউট্টা খাল ও ডেবপুরা খাল, রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া খাল, চালিতাবুনিয়া খাল, বড় বাইশদিয়া খাল, কোড়ালিয়া খাল ও চরমোন্তাজ স্লুইস বাজার খালে প্রায় ১০ হাজারের অধিক মান্তা পরিবারের বসবাস। নদীতে বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ার পর থেকে তারা ভাসমান জীবন যাপন করে। এক ইউসুফ ছাড়া কোনো মান্তা শিশু বিদ্যালয়ে যায় না।
ইউসুফ জানায়, অনেক সংগ্রাম করে তাকে পড়াশোনা ধরে রাখতে হয়েছে। সংসারের অভাব মেটাতে কখনো রাতে, কখনো আবার দিনের বেলা নদীতে মাছ ধরতে যেতে হয়। মাছ না ধরলে সংসার অচল। তাই বিদ্যালয়ে যাওয়া, মাছ ধরা এবং মাছ শিকারের ফাঁকে বই পড়া চলে তার।
তার শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশার কথা জানালেন বাবা ফরিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এখন স্কুলের স্যারেরা সাহায্য করে, টাহা-পয়সা নেয় না। কিন্তু অর রেজাল্ট আরো ভালো করার জন্য প্রাইভেট পড়ানো দরকার। সেই টাহা তো আমার নাই। আবার মেট্রিক (এসএসসি) পাস করলে অনেক টাহার দরকার অইবে, তহন কী করমু? তহন হয়তো অর আর ল্যাখাপড়া অইবে না।’
কর্পূরকাঠী ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি ঘোষ বলেন, ‘ইউসুফ খুব মেধাবী ছাত্র। এ কারণে ওর সব কিছু ফ্রি করে দিয়েছি। ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ওর বিষয়টি জানার পর গত বছর পাঁচ হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছিলেন। ও এত ভালো ছাত্র যে আর্থিক জোগান পেলে মাছ ধরা বন্ধ হতো এবং লেখাপড়ায় আরো ভালো করত।’
বাউফলের ইউএনও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, ‘স্থায়ী বসবাসের অভাবে রাষ্ট্রের সব ধরনের সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রতিকূল পরিবেশে থাকে মান্তারা। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে মেধা রয়েছে তা ইউসুফ প্রমাণ করে দিয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তাকে সবার সহযোগিতা করা প্রয়োজন। তাহলে মান্তা জনগোষ্ঠীর শিশুরা শিক্ষাক্ষেত্রে বেশি উদ্বুদ্ধ হবে। তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা হলে সব শিশু বিদ্যালয়মুখী হবে। আর ইউসুফের সরকারি শিক্ষাবৃত্তির সাহায্য অব্যাহত থাকবে।’
ইউসুফ নৌকায় থাকতেই বলেছিল, ‘আমরা গরিব, মাছ ধরতে হয়। আবার স্কুলেও যেতে হয়। স্যারেরা ভালোবাসেন। তবে বাবার টাকা-পয়সা থাকলে নদীতে মাছ শিকার করতে হতো না। ওই সময়টা বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারতাম। আবার এসএসসি পাস করার পর অনেক টাকা পয়সা লাগবে, বাবা তো পারবে না আমাকে টাকা দিয়ে লেখাপড়া করাতে। মনে হয় আমার লেখাপড়া দুই-এক বছর পরই থেমে যাবে। ওই সব কথা মনে হলে খুব কষ্ট লাগে।’ তাকে কোনো আশার কথা এ প্রতিবেদক শোনাতে পারেননি।