লাঙ্গলের ফলায় নৌকা ফুটো হয়ে গেছে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সদ্য অনুষ্ঠিত রসিক নির্বাচনে ‘রসিক’ জেনারেল এরশাদের মনোনীত প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জেনারেলের সাবেক বরপুত্র শরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুকে ৯৮ হাজার ৮৯ ভোটে পরাজিত করার মাধ্যমে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর লাঙ্গলের ফলায় নৌকার তলা ফুটো করে দেয়ার জন্য অশীতিপর বৃদ্ধ জেনারেলকে জনগণের পক্ষ থেকে স্যালুট জানাচ্ছি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে জাপার অবস্থান বিএনপির ওপরে। বিএনপি সেটা স্বীকার করুক না করুক সংবিধান জাপাকে সেই মর্যাদা দেয়ায় বিএনপির অস্বীকারে কিছু আসে-যায় না। কিন্তু রসিক, খুসিক, বসিক, গাসিক, সিসিক ও কুসিক বিএনপির দখলে থাকায় এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাপার দখলে কোনো সিটি করপোরেশন না থাকায় জেনারেল সাহেব খুবই অস্বস্তিতে ভুগছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত দীর্ঘ দিন অস্বস্তিতে ভোগায় রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে ভারত, চীন ও শ্রীলঙ্কার সাথে সফল দূতিয়ালিতে আত্ম নিয়োগ করতে না পারায় ওই তিনটি রাষ্ট্রই বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়েছে। ইতোমধ্যে রসিক নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ায় বিশেষ দূতকে সন্তুষ্ট করার একটি সুবর্ণ সুযোগ বিশেষ দূতের নিয়োগকর্তা হাতছাড়া করেননি। তিনি ‘এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন’- এরশাদকেও খুশি করেছেন এবং বেগম খালেদা জিয়াকে একটু শিক্ষা দিয়েছেন।

২০১০ সালে চসিক নির্বাচনে ও ২০১৩ সালে রাসিক, খুসিক, বসিক, গাসিক ও সিসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাপার যৌথসমর্থিত প্রার্থীর বিপুল ভোটে পরাজয়ের পর থেকেই পরবর্তী নির্বাচনে তাদের পরাজিত করার উদ্দেশ্যে বিএনপি সমর্থিত মেয়রদের বরখাস্ত করে উপনির্বাচনের নামে তা দখল করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রথমে পুলিশবাদী নাশকতার মামলায় তাদের গ্রেফতার করে সাময়িক বরখাস্ত করে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়। ৬-৯ মাসে জামিনে বের হওয়ার পর নতুন মামলায় পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।

আবার জামিনে বের হয়ে হাইকোর্টে রিট করার পর পদে ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে ওই মামলার চার্জশিট দিয়ে পুনরায় বরখাস্ত ও গ্রেফতার করা হয়। আবার হাইকোর্টে জামিন পেয়ে জেল থেকে বাসায় পৌঁছানোর আগেই বাসে আগুন দেয়ার অভিযোগে অথবা দু-তিন বছর আগের চাঁদাবাজি মামলায় তাদেরকে গ্রেফতারের এই খেলা অদ্যাবধি চলছে। ওই সিটি করপোরেশনগুলোর উন্নয়নমূলক কাজের কোনো বরাদ্দ মেয়রকে না দিয়ে সরকারি উন্নয়ন সংস্থার নামে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।

নির্বাচনকে প্রভাবিত করার মতো কোনো নির্বাহী ক্ষমতা সিটি করপোরেশন মেয়রদের হাতে না থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে প্রার্থী হতে হয়, অথচ মন্ত্রী ও এমপিদের হাতে অঢেল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আইন পাসের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ওইসব সিটি করপোরেশনের আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ ও জাপার সব প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সিটি করপোরেশন, পৌর ও ইউপি নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক করার আইন পাস করে। আর এই আইন বলে ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর পৌর নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে ৮০ শতাংশ পৌরমেয়র পদে সরকারি দলের প্রার্থী জয়ী হন। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনেও সরকারদলীয় শত শত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াসহ ৮০ শতাংশ ইউপি চেয়ারম্যান পদও সরকারি দলের দখলে চলে যায়। অবশ্য সরকারের অংশীদার হিসেবে আনুপাতিক হারে জাপার ভাগে কম পড়েছিল।

আগামী বছর মে মাসের মধ্যে অন্যান্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এর ছয় মাস পরই বর্তমান সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের রেকর্ড জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ সালে গড়তে পারেননি, তাই আগামী নির্বাচনে ১৪ দলের পরাজয়ের কথা চিন্তা করাও জনগণের জন্য হারাম। বর্তমান সরকারের যেহেতু আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা ১০০% নিশ্চিত, সেহেতু ওই সব সিটি করপোরেশনে নৌকার প্রার্থীদের পরাজয় অসম্ভব। কারণ ওইসব সিটি করপোরেশনের বর্তমান নির্বাচিত মেয়রগণ নিজেরাই পুলিশের হয়রানিমূলক মামলা থেকে আত্মরক্ষায় অসমর্থ, সেখানে জনগণ কোন ভরসায় ধানের শীষের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তাদের নিরাপদ জীবনযাপন বিঘ্নিত করবে।

তা ছাড়া বর্তমান সরকারের কাছ থেকে ধানের শীষের নির্বাচিত মেয়রগণ করপোরেশনের নাগরিকদের সেবাদানমূলক কোনো উন্নয়ন প্রকল্প মঞ্জুরি পাওয়ার আশা করতে পারেন না, যা চসিকের সাবেক মেয়র মঞ্জুর আলম হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।

সরকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সিটি করপোরেশনগুলোর আগামী নির্বাচনকে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন বিরোধী দল পরিবর্তনের নির্বাচনে পরিণত করার লক্ষ্য হাসিলের কাজে ব্যবহার করা। যেহেতু ২০১৮ সালের নির্বাচন সরকার পরিবর্তনের নির্বাচনে পরিণত হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনাও নেই, তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও পিএনপির কোনো আশা নেই।

আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কাজ হবে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির গুজরাট ফর্মুলা প্রয়োগ। যেমন বিজেপির নেতারা রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমান ও দলিত হিন্দুদেরকে বলেছিল- ‘শান্তিতে থাকতে চাইলে আমাদেরকে ভোট দাও।

আর এই দাওয়াই প্রয়োগ করেই আহমেদাবাদ ও সুরাটসহ তিনটি বড় শহরের ৩৪টি আসনের মধ্যে ৩২টিতেই বিজেপি প্রার্থীরা জয়ী হয়ে ষষ্ঠবারের মতো গুজরাটে রাজ্য সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন; বাংলাদেশেও তাই হবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলবেন শান্তিতে ও ঝামেলাবিহীন জীবন যাপন করতে চাইলে এবং সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন চাইলে প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দাও, কারণ একাদশ সংসদ নির্বাচনে আমরাই জয়ী হয়ে আগামী ২০২৪ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকব। রসিক নির্বাচনে নৌকার মালিকের সম্মতিতে লাঙ্গলের ফলায় যে ফুটো হয়েছে এটি তার ইচ্ছায় সুপারগ্লুর মাধ্যমে বন্ধ হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর