বাংলাদেশের জাতীয় লাল-সবুজের পতাকার প্রথম রূপকার কেমন আছেন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ শিবনারায়ণ দাশ, একজন নিভৃতচারী  শিল্পী। আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছেই তিনি অচেনা। সবুজ জমিনে লাল সূর্যের বুকে সোনালি মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকার সঙ্গে এই নামটি জড়িত। এই শিল্পীর নকশায় তৈরি করা পতাকা আকাশে বাতাসে স্বগর্বে উড়ে জানিয়েছিল একটি স্বাধীন দেশের আগমনীবার্তা।

১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে রাত ১১টার দিকে পুরো পতাকার ডিজাইন সম্পন্ন করেন ওই সময়ের ছাত্রনেতা ও স্বভাব আঁকিয়ে শিবনারায়ণ দাশ। এ পতাকাই একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলিত হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শিবনারায়ণ দাশের নকশা অনুসরণে পতাকার মধ্য থেকে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পটুয়া কামরুল হাসান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আজকের রূপ দিয়েছিলেন। ।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার মূল নকশাকারী শিবনারায়ণ দাশ থাকেন রাজধানীর মনিপুরি পাড়ায়। তার নকশা করা পতাকা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতি বাংলাদেশ নামের সার্বভৌম একটি ভূখন্ড পেয়েছে। কিন্তু মাথা গোঁজার জন্য শিবনারায়ণের জুটেনি একটুকরো জমি। জীবনের এই পড়ন্ত বেলাতে ভাড়া বাড়িতেই কাটছে দিনরাত্রি। অবশ্য এই নিয়ে মনে নেই কোনো দহন। তিনি এমনই এক শিল্পী; কখোনোই সৃষ্টির নাম বিকিয়ে ছোটেননি মুড়ি-মোয়া জোটাতে, চাননি কোনো স্বীকৃতি। বরং নিজের মতোই আছেন, দেশের জন্য কিছু করার গর্বটাকে ধরে রেখেছেন অন্তরে।

শিবনারায়ণ দাশ লাল-সবুজে আর সোনালি মানচিত্রের পতাকাটির ব্যাখা দিয়েছেন এইভাবে, পতাকাটিতে সবুজ রঙ দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছিল সবুজ বাংলার চিত্র এবং লাল রঙ দেওয়া হয়েছিল সংগ্রাম ও জীবনের প্রতীক হিসেবে। আর মাঝের মানচিত্রটি সোনালি রঙ দিয়ে আঁকা হয়েছিল। স্বপ্ন ও সম্ভাবনা প্রতীক হিসেবে সোনালি রঙ ব্যবহার করা হয় পতাকায় লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র বসিয়ে দেয়ার কারণ, বাংলাদেশ বলতে কোন ভূখণ্ডটি বোঝায়, তা চিহ্নিত করা। স্বাধীনতার পরে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

স্বাধীনতার পর পতাকা থেকে মানচিত্র সরানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, পতাকা সঠিকভাবে তুলে ধরা জাতির কর্তব্য। কিন্তু মানচিত্র থাকায় পতাকাটি আঁকা অনেক কঠিন এবং বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সহজ করে পতাকা আঁকার জন্য মানচিত্রটি সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

শিবনারায়ণ দাশের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিক্রমপুরের টঙ্গীবাড়ি থানায়। কুমিল্লা জেলা স্কুলের ছাত্র হলেও ১৯৬২ সালে পরীক্ষা দিতে পারেননি। কলেজিয়েট স্কুল থেকে পরের বছর এসএসসি পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেন।

ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে টানানো তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইউব খানের ছবি পদদলিত করার কারণে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন জেল থেকে মুক্তি পান সেদিনই শিবনারায়ণ দাশ জেল থেকে বের হন। ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আবারো গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত জেলেই কাটান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩৫ জন আসামির ১৭তম সদস্য ছিলেন তিনি। গণআন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রহিত করতে বাধ্য হয়।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একটা বড় অংম আরো আগেই স্বাধীনতা লাভের জন্য গোপন প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ঊনসত্তরের গণজোয়ারকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ডাইভার্ট করতে ছাত্রনেতারা সচেষ্ট ছিলেন। ৬ দফার আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রদের এগার দফা যুক্ত হয়। অবশেষে ৬ দফার আন্দোলনকে এক দফার আন্দোলনে রূপ দেয়া হয়।

১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশের পর ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ স্বাধীন করতে সশস্ত্র আন্দোলনের ধারা সৃষ্টি করতে হবে। সে লক্ষ্যে ‘১৫ ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি ব্রিগেড গঠিত হয় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। এ বাহিনীর নতুন নাম দেয়া হয় ‘জয়বাংলা বাহিনী’। এ বাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। প্রায় আট হাজার ছাত্রলীগ কর্মীকে এ জন্য প্রস্তুত করা হয়। জয়বাংলা বাহিনীর জন্য প্রয়োজন হয় একটি পতাকা। নির্দিষ্ট দিবসকে সামনে রেখে সেই পতাকাটির ডিজাইন করেন শিবনারায়ণ দাশ। সেটিই পরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় রূপান্তরিত হয়।

শিবনারায়ণ দাশের বাবার নাম সতীশ চন্দ্র দাশ। তিনি কুমিল্লাতে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদাররা শিবনারায়ণ দাসকে খুঁজে না পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। আজও পিতার লাশটি খুঁজে পাননি তিনি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লায় প্রথম আক্রমণ চালায় তাদের বাগিচাগাঁওয়ের বাসায়। তাকে না পেয়ে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। সে রাতেই তাকে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। শিবনারায়ণকে ধরার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে মাইকিং করা হয়। ঘটনার সময় তিনি শাসনগাছায় দলীয় কর্মীদের নিয়ে গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন। পরে আগরতলা পেরিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন শিবনারায়ণ দাশ। জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে তো নয়ই, এমনকি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ ফেরত অন্য অনেকের মতো তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে একমত হতে না পেরে জাসদে নাম লেখান। জেল, নির্যাতন ভোগ করেন। পরবর্তীতে জাসদের বৈপ্লবিক নীতি, আদর্শ বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তার মতানৈক্য ঘটে। দিনে সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা, রাতে এক টেবিলে বসে আপসকামিতা মানতে পারেননি। তাই রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা হারান। হয়ে ওঠেন নিভৃতচারী।

পতাকা তৈরির স্মৃতিচারণে শিবনারায়ণ বলেন,যারা স্বাধীনতার সংগঠক ছিলেন, যারা স্বাধীনতার প্রত্যাশায় উজ্জীবিত ছিলেন, যারা সংগঠন তৈরি করেছেন, যারা গোপনে কাজ করেছেন নিজের জীবনকে বাজি রেখে, মূলত সেই সংগঠক, সংগঠন ও সেই নেতারাই পতাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সে সময়ে আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল পতাকা তৈরি করার। আমি পরিকল্পনা মাফিক সে দায়িত্ব পালন করেছি। আমার হাতেই পতাকা তৈরির কাজ শুরু ও শেষ হয়।

শিবনারায়ণ দাশ বলেন, পতাকাটি তৈরি করা হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য, স্বাধীন জাতির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য। ‍কিন্তু ৪৩ বছর পরে এসেও এই দেশে যে স্বেচ্ছাচারিতা, সন্ত্রাস, অবিচার ও জঙ্গিবাদের আতঙ্ক দেখতে পাই, তাতে মনে হয়, এই দেশের জন্য পতাকাটি তৈরি করা হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কখনো তার  নাম উঠেনি জানিয়ে নিভৃতচারী এই শিল্পী বলেন, এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। জাতির কাছেও আমার চাওয়ার কিছুই নেই। জাতির প্রয়োজনে কাউকে না কাউকে কিছু করতে হয়, আমিও সেরকম একটি কাজ করেছি। কোন পুরস্কার বা খ্যাতির জন্য করিনি, আর চাইও না।

এই সময়ের রাজনীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত লাভ-লোভের জন্য নয়, রাজনীতি হতে হবে দেশ ও জনগণের জন্য। আমরা তোতা পাখির মতো মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, দেশ, জনগণ ইত্যাদি কপচায়; কিন্তু উপলব্ধি করি না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর