সুশাসন ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বে দৃষ্টান্ত হবে বাংলাদেশ

ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্বের জনক, বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ও পরিচিত বাংলাদেশি নাগরিক। সম্প্রতি ড. ইউনূস ও তার নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব ‘সামাজিক ব্যবসা’ বিশ্বব্যাপী আবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এ ব্যবসায় মুনাফা হয় কিন্তু ওই মুনাফা মালিক নেন না। মুনাফাটা তার মধ্যেই থেকে যায়, রিসাইকেল করে বড় হয়, প্রতিষ্ঠান বড় হয়। মানুষের সমস্যার সমাধান করে। এই সামাজিক ব্যবসার ডাক দিয়ে থেমে থাকেননি কর্মবীর ইউনূস। তা প্রতিষ্ঠিতও করেছেন। বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে ‘সোশ্যাল বিজনেস চেয়ার’, ‘ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল বিজনেস’ ইত্যাদি। ইতিমধ্যে ড. ইউনূস তার এই ধারণার তাত্তি্বক রূপ দিয়েছেন ‘‘Building Social Business : The New Kind of Capitalism that Servs Humanity’s Most Pressing Needs’ বইটিতে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শেখ মেহেদী হাসান

আমাদের দেশে আপনি শুরু করলেন বিকল্প ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মাইক্রোক্রেডিট। থিওরিটাই আপনি বদলে দিলেন। এরপর এক সময় আপনি বললেন যে, তথ্যপ্রযুক্তিই আমাদের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে। সাম্প্রতিক সময়ে আপনি ‘সামাজিক ব্যবসা’র ধারণা দিয়েছেন। এ তিনটার মধ্যে কি কোনো ইন্টারলিঙ্ক আছে?

তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবসা, ক্ষুদ্রঋণ কোনোটাই কোনোটার থেকে পৃথক নয়। মানুষের জীবন অনেক কিছু মিলিয়ে, অনেক কিছুর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে। আমরা বিবেচনা এবং কাজের সুবিধার জন্য একেক সময় একেকটা নিয়ে বিশ্লেষণ করি, একেকটার ভূমিকার ওপর মনোযোগ দিই, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপায় খুঁজি। ক্ষুদ্রঋণ বা গরিবের কাছে ব্যাংকিং পৌঁছানোর গুরুত্ব কাউকে নতুন করে ব্যাখ্যা করে বলার এখন আর দরকার হয় না। যেমন স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষার ব্যাপারে কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। আমি ঘটনাক্রমে গরিবের কাছে ঋণ সুবিধা পৌঁছানোর কাজে লেগে পড়ি। এ কাজ করতে গিয়ে এর মধ্যে এক বিশাল জগৎ আবিষ্কার করলাম। এক বিশাল সম্ভাবনার দিগন্ত খুঁজে পেলাম। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে গরিবের সঞ্চয় সংগ্রহের রাস্তা বানিয়ে দিলাম, গৃহঋণের ব্যবস্থা করলাম, ঘরে ঘরে টয়লেট স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করলাম, স্বাস্থ্য ইন্স্যুরেন্সের প্রবর্তন করলাম, শিক্ষাঋণের ব্যবস্থা করলাম। অর্থাৎ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যা কিছু করা সম্ভব মনে হয়েছে তা সংযোজন করলাম। কিন্তু ব্যাংকিংয়ের বাইরে যে জগৎ সেটা তো ব্যাংকিং দিয়ে নাগাল পাওয়া যাবে না। আমি সেদিকে মনোযোগ দিলাম। তখন একের পর এক সৃষ্টি হলো নতুন ব্যবসা। দেশে সৌরশক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ব্যবস্থা করা, চক্ষু হাসপাতাল স্থাপন করা, নার্সিং কলেজ স্থাপন করা, পুষ্টিহীনতা দূর করার জন্য ‘শক্তি দই’ উৎপাদন করা, পানির সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রামে পানি পরিশোধনের কোম্পানি স্থাপন করা ইত্যাদি। আর সব কিছুর পেছনে আছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির জগৎ এক প্রচণ্ড শক্তিধর এক জগৎ। প্রযুক্তিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া একেবারেই বোকামির কাজ। তার পিঠে সওয়ার হতে পারলে অসম্ভব সম্ভব হয়। কাজেই তার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়লাম। মোটকথা হলো আমাদের চাই মানুষের সমস্যার সমাধান। যে ভঙ্গিতে, যে আঙ্গিকে তার সমাধান পাওয়া সম্ভব হবে মনে করেছি সেখানেই জড়িয়ে পড়েছি। আমি তিনটি শূন্যকে লক্ষ্য করে আমার কাজগুলো দাঁড় করার চেষ্টা করি। প্রথম শূন্য : পৃথিবীতে দারিদ্র্যকে শূন্যে নামিয়ে আনা, দ্বিতীয় শূন্য : সমগ্র পৃথিবীতে বেকারত্বকে শূন্যে নামিয়ে আনা, তৃতীয় শূন্য : পৃথিবীকে শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ পর্যায়ে নিয়ে আসা। তার জন্য যা যা করা আমার পক্ষে সম্ভব তাই করার চেষ্টা করছি।

আপনি যেভাবে সামাজিক ব্যবসাকে অভিহিত করছেন, সেটা মানুষের চিন্তাকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বের বেশ কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বিদেশে এর প্রতিক্রিয়াটা কী? কোনো সমালোচনা আসছে কি না?

নতুন কিছু করতে গেলে সমালোচনা তো হবেই। সমালোচনা থেকে শেখাও যাচ্ছে। সমালোচনার মাধ্যমে আমার কথা আমার কাছে আরও পরিষ্কার হচ্ছে। আমি এখন আরও পরিষ্কার করে কথাটা বলতে পারছি। দুনিয়ার সব দেশেই মূলত একই সমস্যা। কোনো দেশে একটি সমস্যার পরিমাণ বেশি, আরেকটির পরিমাণ কম। ধনী-গরিব সব দেশে দারিদ্র্য আছে, স্বাস্থ্যহীনতা আছে, বেকারত্ব আছে, ভীষণ রকমের আয় বৈষম্য আছে, জলবায়ুর সংকট আছে ইত্যাদি। এক দেশে সমাধান পাওয়া গেলে এটা সব দেশেই খাটে। যেমন আমরা ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ করলাম বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে। কিন্তু এটা এখন সুন্দরভাবে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের প্রায় সব দেশে। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে সব দেশেই কৌতূহল আছে। কেউ এটাকে পত্রপাঠ বিদায় দিচ্ছে না। তার একটা প্রমাণ উন্নত পৃথিবীর দেশগুলোর বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক ব্যবসা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে, ‘চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন বড় বড় বহুজাতিক ব্যবসা সামাজিক ব্যবসা করার দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং সত্যি সত্যি সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করছে।

সমালোচনা হিসেবে যেটা আসে সেটা হলো : ১. মানুষ যদি ব্যক্তিগত মুনাফা করতে না পারে তাহলে এমন ব্যবসায় মানুষ আগ্রহী হবে না। ফলে সামাজিক ব্যবসা এক ধরনের অনুদাননির্ভর বিষয় হয়ে থেকে যাবে। এটা হবে এনজিওর নতুন সংস্করণ। ২. এর জন্য বিনিয়োগের টাকা পাওয়া যাবে না। ৩. এর জন্য উদ্যোক্তা পাওয়া যাবে না। এর জন্য উদ্যোক্তা হতে হলে তাকে ‘বদ্ধ-পাগল’ হতে হবে, ইত্যাদি।

সমালোচনার জবাব নিয়তই দিয়ে যাচ্ছি। আমার শেষ কথা হলো মানুষের মনে দাগ কাটে না এমন কোনো জিনিসই টেকসই হতে পারে না। সামাজিক ব্যবসার চূড়ান্ত বিচার হবে এটা মানুষের মনে দাগ কাটতে পারছে কি না এবং বর্তমান অ-টেকসই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে টেকসই ব্যবস্থায় নিয়ে যেতে পারবে কি না। দুই ক্ষেত্রেই আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে সামাজিক ব্যবসা এটা পারবে।

সামাজিক ব্যবসার চিন্তা নিয়ে একাডেমিক জগতে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধরনের নাড়া পড়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর অবস্থা কী? নীতিনির্ধারক পর্যায়ের লোকজন কি এ নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে?

একাডেমিক জগতে যে ভালো সাড়া জাগিয়েছে তার একটা প্রমাণ হলো এখন শুধু সামাজিক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একাডেমিকদের বিশ্ব সম্মেলন হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা এখনো সতর্ক অবস্থানে আছে। তারা বাম-ডানের শ্রেণিবিন্যাসে এটার জায়গা কীভাবে হবে সেটা পর্যালোচনা করছে। আমি বলছি বংশ পরম্পরায় মানুষকে রাষ্ট্রীয় অনুদানের ওপর নির্ভরশীল রাখা অন্যায়। সেটা বাম-রা পছন্দ করে না। আমি বলছি বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়া এবং এটা সারা পৃথিবীকে ত্বরিত গতিতে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা ডান-রা পছন্দ করে না। কিন্তু যখনই দেখিয়ে দিই যে মানুষ মাত্রই স্রষ্টা এবং সমস্যা সমাধানকারী, তাই কাউকে কোথাও বেকার থাকার প্রয়োজন নেই, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সবাইকে উদ্যোক্তায় পরিণত করা যায়, তখন বাম ও ডান সবাই আগ্রহী হয়ে শুনতে চাই। বুঝতে চাই। উভয় পক্ষের রাজনীতিবিদরা আমাকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের দেশে কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য।

সামাজিক ব্যবসার অন্যতম প্রতিপাদ্য, ‘আমরা চাকরি প্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা, যুব বেকারত্বকে উদ্যোক্তায় রূপান্তর।’ সেটি কীভাবে সম্ভব?

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একজন মহিলা নিজে নিজের রোজগারের একটা ব্যবস্থা করে নেয়। অর্থাৎ তিনি চাকরি প্রার্থী হন না। তিনি নিজেই নিজের ব্যবসা শুরু করেন। এর জন্য কাউকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। গ্রামের নিরক্ষর, দুনিয়ার সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীন মহিলা যদি নিজে নিজে রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারে অর্থাৎ উদ্যোক্তা হতে পারে, শিক্ষিত তরুণ-তরুণী, যারা পৃথিবীর অনেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে সে কেন নিজের রোজগার নিজে করতে পারবে না, নিজের আয়ের সমস্যা নিজে সমাধান করতে পারবে না। এখন সে পারছে না, কারণ তাকে ভুল কাজের পেছনে লাগিয়ে রেখেছি : যাও, চাকরি খোঁজ। চাকরি না পেলে জীবন ব্যর্থ। টাকা লাগলে টাকা ঢালো। কিন্তু চাকরি চাই। চাকরিই জীবনের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু। ভুল চিন্তাই ‘বেকারত্ব’ নামক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এটা একটা কৃত্রিম সমস্যা। মানুষকে যারা ভুল পথ দেখিয়েছে তারাই এ সমস্যার সৃষ্টি করছে।

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের কথা বলছেন। এর আওতায় আমাদের দেশের কত সংখ্যক মানুষকে আনা সম্ভব?

সামাজিক ব্যবসা হলো মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য সৃষ্ট ব্যবসা। এটা শুধু মানুষের মৌলিক সমস্যা সমাধান করেই ক্ষান্ত হবে তা ঠিক নয়। যতদিন মানুষের সমস্যা থাকবে ততদিন সামাজিক ব্যবসা কাজে লাগবে। সামাজিক ব্যবসার আওতায় দেশের এবং পৃথিবীর সব মানুষকে আনা যায়। স্বাস্থ্যসেবার কথা ধরুন, শিক্ষার কথা ধরুন, পরিবেশ সমস্যার কথা ধরুন, মানবিক অধিকারের কথা ধরুন- এটা সবার সমস্যা। সামাজিক ব্যবসা সবার কাজে লাগবে।

গত ২৮ মে সামাজিক ব্যবসা দিবসে আপনি বলেছিলেন, তিনটি শূন্য নিশ্চিত করতে পারলেই বিশ্ব এগুবে। শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব আর শূন্যমাত্রার কার্বন নিঃসরণ। এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলুন।

আমার বক্তব্যটি ছিল বর্তমান যে অর্থনৈতিক বিশ্বকাঠামো তা পৃথিবীতে কতগুলো সমাধানহীন মৌলিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং সেগুলো ক্রমাগতভাবে আরও গভীরতর সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। যেমন আয়-বৈষম্যের সমস্যা। পৃথিবীর সব সম্পদ ক্রমাগত স্বল্পতর সংখ্যক মানুষের করায়ত্ত হয়ে আছে। এ থেকে নিস্তার নেই। দেশের মধ্যেও এর থেকে নিস্তার নেই। পৃথিবীর বিচারেও এর থেকে মাফ নেই। এর সঙ্গে আছে পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশের সমস্যা। এটাও ক্রমাগতভাবে কঠিনতর হচ্ছে। এর সঙ্গে আমি ক্রমবর্ধমান হারে পৃথিবীর লোকসংখ্যার কথাটি উল্লেখ করেছিলাম। ৩০ লাখ বছর সময় লেগেছিল সারা পৃথিবীর লোকসংখ্যা মাত্র ১০ লাখে পৌঁছতে। মানুষের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছার পর থেকে আরও ২০ হাজার বছর সময় লেগেছিল পৃথিবীর লোকসংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছতে। আজকের তারিখ থেকে মাত্র অল্প কয়েক বছর আগে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছে। ১৮০৪ সালে। ১০০ কোটি থেকে ২০০ কোটিতে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ১২৩ বছর, ১৯২৭ সালে। ২০১১ সালে লোকসংখ্যা ৭০০ কোটিতে পৌঁছল। তখন থেকে প্রতি ১২ বছরে ১০০ কোটি করে লোকসংখ্যা বাড়ছে। যে হারে পৃথিবীর লোকসংখ্যা বাড়ছে তাতে একই রকম অর্থনৈতিক কাঠামো যদি চালু রাখি এবং অল্প কিছু মানুষের হাতে যদি পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য যদি বর্তমান হারে নষ্ট হতে থাকে তাহলে সে পৃথিবী বাসযোগ্য রাখা যাবে কিনা আমি সে প্রশ্ন তুলেছিলাম।

আমি মনে করি যে ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক যে সভ্যতা আমরা গড়ে তুলেছি সেটাকে সম্বল করে এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এ সভ্যতা ত্যাগ করে আমাদের নতুন সভ্যতা গড়তে হবে। এই নতুন সভ্যতা গড়ার পথে আমাদের প্রথম কাজ হবে তিন শূন্য অর্জন করা। শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ। এই তিন শূন্য অর্জনের মাধ্যমে আমরা নতুন সভ্যতায় প্রবেশ করব। সে সভ্যতার মূল ভিত্তি হবে এই তিন শূন্য। এই তিন শূন্য অর্জন করতে গিয়েই আমরা নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর গোড়াপত্তন করব। বর্তমানের পুরনো সভ্যতা ছেড়ে নতুন সভ্যতায় উত্তরণের দিন-তারিখ নির্ধারণ করে বলেছিলাম যে, ২০৫০ সালের মধ্যেই নতুন সভ্যতায় প্রবেশের সব আয়োজন আমাদের সমাপ্ত করতে হবে।

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু নিশ্চিত করা যাবে?

সামাজিক ব্যবসা হলো কারিগরের হাতে একটা নিপুণ সরঞ্জাম। এই সরঞ্জাম দিয়ে কারিগর কী শিল্প ফুটিয়ে তুলবে সেটা কারিগরের লক্ষ্য ও তার নৈপুণ্যের ওপর নির্ভর করবে। সামাজিক ব্যবসাকে আপনি যে কাজে খাটাতে চান সে কাজে সফল হওয়া, ব্যর্থ হওয়া সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনি ব্যবসাটি সঠিকভাবে রূপায়ণ করতে পেরেছেন কিনা তার ওপর।

কোনো ধরনের সামাজিক ব্যবসায় নারীর ক্ষমতায়ন কী পরিমাণ বাড়বে সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে যেটাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতায়ন হবে সেটা বেছে নিয়ে কাজ শুরু করুন। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন যেমন সম্ভব, নারীর ক্ষমতায়নও তেমনি সম্ভব। এটা ইচ্ছার ব্যাপার এবং তার সঙ্গে আছে উপযুক্ত পদ্ধতির ব্যাপার। সামাজিক ব্যবসা এ কাজে বড় রকমের সহায়ক হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশ্বব্যাপী সামাজিক বৈষম্য দূর করে কীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো যেতে পারে?

অর্থনৈতিক বৈষম্য আর সামাজিক বৈষম্য একই সুতোয় গাঁথা। একটি বাড়লে আরেকটি বাড়বে। একটি কমলে আরেকটি কমবে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বে এটা তার কাঠামোর ভিতরে সনি্নবেশিত করা আছে। এটা এড়ানোর বহু রকম চেষ্টা-তদবির চলতে থাকে। বিশেষ করে সরকারের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এটার গতি কমানোর প্রয়াস হয়। কিন্তু এটা সুনামির মতো। সরকারের হস্তক্ষেপে এটাকে থামানো যায় না। সরকারও এ সুনামির কাছে অসহায়। যদ্দিন ব্যক্তিগত মুনাফাই ব্যবসার সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি হবে ততদিন এটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগুবে।

সামাজিক ব্যবসা একটা বিপরীতধর্মী ব্যবসা। এটা ব্যক্তিগত মুনাফা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে। কাজেই এর মাধ্যমে ব্যক্তির হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবন সম্ভব নয়। যতই সামাজিক ব্যবসার আওতা বাড়বে ততই সম্পদের ঊর্ধ্বমুখী গতি কমবে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নিচের আয়ের মানুষের সম্পদ আহরণের সুযোগ বাড়বে। সবাই উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পাবে। চাকরিনির্ভর জীবন থেকে মুক্ত হবে। পুঁজি এবং প্রযুক্তি নিচের আয়ের মানুষ এবং পরিত্যক্ত জনগোষ্ঠীর দিকে এগিয়ে যাবে। প্রত্যেকের নিজস্ব সৃজনশীল শক্তি বিকাশের সুযোগ আসবে। এতে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়বে।

আপনার কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের ছবিটা কেমন?

শূন্য দারিদ্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণের বাংলাদেশ গড়া। তরুণদের শক্তি এবং নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তির শক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার মহাযজ্ঞ সৃষ্টি করা। এদেশের ছেলেমেয়েরা উদ্ভাবনীমূলক নানা রকম সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করে, ক্রমাগতভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করে, ক্রমাগতভাবে পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকবে- এরকম একটা ছবি মনের মধ্যে পুষে রাখি। সুশাসন ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্তমূলক দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবে এরকম গৌরবময় একটি জীবনের আশা মনে রাখি।

বাংলাদেশের তরুণদের জন্য আপনার উপদেশ কী?

বর্তমানের তরুণদের মহাশক্তি দেখে আমি ঈর্ষান্বিত হই। কিন্তু যে-তরুণরা এ শক্তির অধিকারী তারা কি অবগত আছে যে তাদের মধ্যে এ শক্তি আছে? যে শক্তির অধিকারী হওয়া সম্বন্ধে তরুণরা সচেতন নয়, সে শক্তি থাকা আর না থাকা একই কথা হবে। কারণ সে শক্তির কোনো ব্যবহার হবে না। অব্যবহৃত শক্তি পচে যায়। তরুণদের প্রতি আমার অনুরোধ তোমরা কেউ তোমাদের শক্তিকে পচে যেতে দিও না। মানুষের একটাই জীবন। তাই একবারের বেশি সুযোগ কিন্তু পাবে না। তোমার ভিতরে অসম্ভব সৃজনশীল শক্তি বাসা বেঁধে আছে। তাকে বের করে আন। কাজে লাগাও। চাকরির পেছনে ঘুরে জীবনকে ক্ষুদ্র পরিসরে গুটিয়ে রেখ না।

তোমার মাঝে যে শক্তি আছে সেটা চোখের সামনে যদি দেখতে পেতে তুমি অবাক হয়ে যেতে। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ কর। তাকে হুকুম কর। তাকে কাজে লাগাও। তাকে কাজে লাগালে তোমার সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অসম্ভবগুলো একে একে সম্ভব হতে আরম্ভ করবে। নিজেকে আবিষ্কার করতে সংকোচ কর না। পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো তরুণের চেয়ে তুমি কোনো অংশে কম নয়। তুমি জেগে ওঠ এবং দুনিয়ার সব তরুণকে জাগিয়ে তোলো। পৃথিবী তোমার ভবিষ্যৎ। তুমি পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর