মনে হয়েছিল ক্রিকেট ছেড়ে দেবো

‘বাসা থেকে অনুশীলনে যেতে রিকশা ভাড়া মাত্র ৫০ টাকা। কিন্তু ভাড়া কোথায় পাবো, দুটি বছর হেঁটে হেঁটেই অনুশীলনে যেতাম। তবুও ক্রিকেট ছাড়িনি। এখনতো মনে হয় রাজার হালে আছি। ছোটবেলা থেকেই মোবাইলের প্রতি অনেক দুর্বলতা, এখন কত সহজেই নতুন নতুন মোবাইল কিনি। সব কিছুই সম্ভব হয়েছে ক্রিকেটের জন্য। জীবনের অনেক কিছুই বদলে গেছে। এমনকি ব্যাটসম্যান হিসেবে শুরু করলেও এখন পেসার। তবে এটাও সত্যি ক্রিকেট যেদিন ছেড়ে দেবো তখন থেকে এই ক্রিকেটের সঙ্গে থাকবোই না। অবশ্য তার আগে দেশ ও দলকে উজাড় করে দিতে চাই।’- এভাবেই জাতীয় দলের পেসার মোহাম্মদ শহীদ, কখনও স্মৃতি হাতড়ে, কখনও কল্পনায় ভেসে নিজের স্বপ্ন ও জীবনের কথাগুলো বলে গেলেন অনর্গল। তার বদলে যাওয়া জীবনের সেই গল্প তুলে ধরছেন মানবজমিন-এর স্পোর্টস রিপোর্টার ইশতিয়াক পারভেজ
প্রশ্ন: খেলা শুরু করেন কোথায়?
মোহাম্মদ শহীদ: আমি নারায়ণগঞ্জের বরফ কল মাঠে খেলা শুরু করি অসিত স্যারের কাছে। কিছুদিন যেতেই পাইকপাড়ার জিমখানা মাঠে রসুল স্যারের একাডেমির সঙ্গে একটি ম্যাচ ছিল আমাদের। সেখানে আমি তিন নম্বরে খেলতে নেমে সেঞ্চুরি করি। এরপরই রসুল স্যার আমাকে ডাকেন। প্রথম আমি যেতে চাইনি। পরে আবার যখন ডাকে তখন যাই। স্যারকে জানাই মাত্র দুই সপ্তাহ হলো অনুশীলন করেছি। ঢাকাতে কখনও খেলিনি। তখন তিনি তার কাছে অনুশীলন করতে বলেন। সেই সঙ্গে আমাকে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবে খেলানোর কথাও বলেন।
প্রশ্ন: ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিলেন?
শহীদ: ছোটবেলায় আমি পাকিস্তান ও আফ্রিদির ভক্ত ছিলাম। তার কারণে আমি ভেবেছিলাম ব্যাটসম্যান হবো। ব্যাটিং করতেই ভাল লাগতো। বল করতাম, কিন্তু জোরে কোন লাইন লেন্থ ছিল না।
প্রশ্ন: ব্যাটিং ছেড়ে পেসার হয়ে গেলেন…
শহীদ: বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে একটি ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচেই আমি মাশরাফি ভাইকে দেখি। তার বোলিং স্টাইল আমার ভীষণ ভাল লাগে। তখন থেকে চিন্তা করি পেসার হবো।
প্রশ্ন: মাশরাফি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন কিন্তু মাঠে বল করার সাহস পেলেন কিভাবে!
শহীদ: উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে তৃতীয় বিভাগে আমার প্রথম ম্যাচ ঢাকায় খেলি। সেই ম্যাচেই ৮ উইকেট পাই। ভেবেছিলাম ব্যাট হাতে ভাল করবো। কিন্তু করেছিলাম ২০ রান। তবে ১০৮ রানে আউট হয়েও ওদের ৬৯ রানে গুটিয়ে দিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: ঘরোয়া ক্রিকেটে কত বছর খেললেন?
শহীদ: সাত বছর খেলছি। প্রথম বড় ক্লাব গোপীবাগ। আর প্রিমিয়ার লীগে প্রাইম দোলেশ্বর।
প্রশ্ন: প্রথম বড় অংকের টাকা পেয়েছিলেন কবে?
শহীদ: আমি অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দলের পক্ষে ভাড়ায় বা সম্মানীর বিনিময়ে খেলতাম। খুশি হয়ে কেউ ৫০০, কেউ ৩০০ টাকা দিত। সেটি দিয়ে রিকশা ভাড়া দিতাম। কারণ তখন কোচিং করতে যেতে খুব কষ্ট হতো। একবার ১৫ হাজার টাকা পাই। সেটা নিজেই খরচ করি। তবে সবচেয়ে বেশি টাকা প্রাইম দোলেশ্বরে খেলে। ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। বাসার জন্য কিছু খরচ করেছি। কারও হাতে দেইনি, মনে হয়েছে অনেক কষ্টের টাকা কারও কাছে দিবো না। ইচ্ছামতো খরচ করেছি, যা খুশি কিনেছি।
প্রশ্ন: অনেক কষ্টের টাকা বলতে…
শহীদ: আমি যখন অনুশীলন শুরু করি তখন বাসা থেকে মাঠে যেতে ভাড়া লাগতো ৫০ টাকা। টাকা কে দেবে? হেঁটে হেঁটে যেতাম আর আসতাম। টানা দুই বছর এভাবেই কষ্ট করেছি। মনে হয়েছিল ক্রিকেট ছেড়ে দেবো কিন্তু কোচ রসুল স্যার খুব মায়া করতেন। কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতেন আর বুঝাতেন তুমি ভাল খেলো। তোমার খেলা খুব ভাল হবে কষ্ট করে যাও। তাই কষ্ট করেছি। ক্রিকেট ছাড়িনি।
প্রশ্ন: তাহলে এখন কেমন আছেন?
শহীদ: খুবই ভাল, মনে হয় রাজার হালে আছি। জানেন, আমার মোবাইলের প্রতি খুবই দুর্বলতা। নতুন নতুন মোবাইল দেখলেই কিনতে ইচ্ছা করতো। যখন অল্প টাকা ছিল তখনও ৪/৫ হাজার টাকায় মোবাইল কিনতাম। এখনতো নতুন কোন মোবাইল এলেই কিনে ফেলি যত দামিই হোক।
প্রশ্ন: অনেক কষ্টের পর তাহলে জাতীয় দলে…
শহীদ: অবশ্যই, যখন খুলনাতে বল হাতে ছুটছিলাম। আমি তখন খুশিতে কাঁদছিলাম। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না জাতীয় দলে খেলছি। ভুলে গিয়েছিলাম কার বিপক্ষে খেলছি, কাদের বল করছি। শুধু একটাই বিশ্বাস ছিল ভাল করতেই হবে। একটু ফাঁকি দিলেই আর জায়গা হবে না। আত্মবিশ্বাস ছিল পারবো।
প্রশ্ন: প্রথম টেস্টে এতটা আত্মবিশ্বাস!
শহীদ: আমি অনেক লঙ্গার ভার্সন খেলেছি। যেটি আমাকে সাহস দিয়েছে। যদিও ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ এক নয়, তবুও লঙ্গার ভার্সনে খেলেছি বলে আমি কিছুটা হলেও জানি এখানে কি করতে হয়।
প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত সেরা উইকেট শিকার কোনটি?
শহীদ: আমি হাফিজের উইকেটটা সারাজীবন সেরা বলবো। কারণ ওকে আউট করার পর মনে হয়েছে আমি এই দেশের একজন পেস বোলার। এরপর ইউনুস খানের উইকেটও আমার সেরা শিকার হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন: নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
শহীদ: অবশ্যই টেস্টে দেশের সেরা পেসার হয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই। আল্লাহ্‌র উপর ভরসা আছে সে চেষ্টাই করে যাবো। কিন্তু একটা কথা সত্যি যে, আমি যখন ক্রিকেট ছেড়ে দেবো তখন আর ক্রিকেটেই থাকবো না। হয়তো দূর থেকে সমর্থন দেবো, যারা খেলতে চায় তাদের পারলে সাহায্য করবো। আমি কোন ব্যবসাও করবো না। একটি বাড়ি করতে পারলে আর যদি গাড়ি কিনতে পারি তাতেই আমার চলে যাবে।
প্রশ্ন: জীবন কতটা বদলে গেছে?
শহীদ: অনেক কিছু বদলে গেলেও খাওয়ার অভ্যাস বদলায়নি। আমার প্রিয় খাবার বিরিয়ানি ও গরুর মাংস। যখন খেলা থাকে, সিরিজ থাকে, অনুশীলন থাকে চেষ্টা করি নিজেকে সামলে রাখতে। কিন্তু যখন পারি না আত্মাকে শান্তি দিতে খেয়ে ফেলি। তবে আমি কিন্তু ভাল বিরিয়ানি রান্নাও করতে পারি। আমার মাও ভাল বিরিয়ানি রান্না করেন।
প্রশ্ন: মেয়েরা নিশ্চয়ই এখন ফোন করে, বিয়ের প্রস্তাব দেয়
শহীদ: মেয়েদের ফোন আসে, কিন্তু বিয়ের কথা বললে বুঝিয়ে বলে দিই এ সব চলবে না। আবার ভালও লাগে কথা বলতে।
প্রশ্ন: অহঙ্কার আর দম্ভ বাড়ছে মনে হয়…
শহীদ: না, এটা কখনও হবে না। আমি মনে করি, আগে একজন ভাল মানুষ তারপরই একজন ভাল ক্রিকেটার। আমি সবার সঙ্গে মিশি। এমনকি এখনও নারায়ণগঞ্জের সেই জিমখানা মাঠে আগের মতোই খেলি।
প্রশ্ন: খেলার মাঠে কোন আফসোস?
শহীদ: জাতীয় দলে ঢোকার পর শুনলাম রাজীব ভাই (শাহাদাত হোসেন) খেলবে। ভেবেছিলাম আমরা নারায়ণগঞ্জের দুইজন দুইদিক থেকে বল করবো। কিন্তু হলো না। হবে কিনা জানি না। এটাই আফসোস।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর