সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার পর্নোর অপবাদে গৃহবন্দি সেই নারী

পর্ন ভিডিওতে দেখা যাওয়ার অপবাদ দিয়ে দিনাজপুরে পরিবারসহ যে গ্রাম্যবধূকে ছয় মাস একঘরে করে রাখা হয় তাকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিসাধীন রেহেনা এ অভিযোগ করেন। চিরিরবন্দর থানার ওসি আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে মামলার আরজি পরিবর্তনের অভিযোগ এনে তার সংবাদ সম্মেলন করার দুদিন পর এই ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র।

ঘটনার শিকার দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার রেহেনা অভিযোগ করেন, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে পাশের বাড়ি থেকে ফেরার পথে তাকে তুলে পাশে জঙ্গলে নিয়ে হাত-মুখ বেঁধে ধর্ষণ করে সাইদুল মাস্টার, মঞ্জুরুল ইসলাম, রকিবুল ইসলাম ও অজ্ঞাত পরিচয় একজন।প্রথমোক্ত তিন জন আগে তাদের নির্যাতন করা মামলার আসামি বলে জানান রেহানা।

“এছাড়া মামলা না তুললে এবং পুলিশের বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ করলে হত্যার হুমকি দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষরও নেয়। ”

পরে বাড়ির সামনে ফেলে যায় বলে জানান তিনি। “বাড়ির লোকজন রাতে উদ্ধার করে রেহেনার দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।”

এদিকে হাসপাতালে রেহেনাকে দেখতে গিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দিনাজপুর কমিটির সভানেত্রী কানিজ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “পুলিশের দায়িত্বহীনতার কারণে রেহেনার উপর যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। ”

অপরাধীদের পুলিশ গ্রেপ্তার না করলে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করারও হুমকি দেন তিনি। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. ফয়সাল আলম বলেন, “রেহেনার সেক্সুয়াল ইনজুরির প্রমাণ পাওয়া গেছে।”

ওসি আনিছুর রহমান তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে বলেন, “মামলার একদিন পরেই আসামিরা আদালত থেকে জামিন নিয়েছে। জামিনের পর আর তো গ্রেপ্তার করা যায় না।”

মামলার বাদী এনামুল হক ও মামলা সূত্রে জানা যায়, চিরিরবন্দরের আউলিয়াপুকুর ইউনিয়নের গালতৈড় কাচলডাঙ্গা গ্রামের এনামুল হকের মেয়ের মত দেখতে এমন একটি নীলছবির ভিডিও ওই এলাকার খয়রদ্দিনের ছেলে রফিকুল (৩৪), মকবুল হোসেনের ছেলে মঞ্জুরুল (৩২) গ্রামের লোকজনদের দেখিয়ে কুৎসা রটানো শুরু করে। এতে গ্রামের লোকজন তাদের অপমান অপদস্ত করতে থাকে। তাদের পরিবারকে সমাজচ্যুত করে একঘরে করে রাখে। গত ১০ জুলাই শুক্রবার এনামুল হক মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালী আবুবক্কর সিদ্দিক (৭০), তার ৩ ছেলে ওয়াহেদুল, শহিদুল ও রাশেদুল, মকবুল হোসেনের ছেলে জসিম, পানুয়া মুন্সির ছেলে আতাব আলী তাকে মসজিদে প্রবেশে বাঁধা প্রদান করে এবং বেধড়ক মারপিট করে। বিচারের কথা বলে আবুবক্কর সিদ্দিকের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুনরায় মারপিট শুরু করে। সংবাদ পেয়ে তার মেয়ে রাহেনা ও জামাই হোসেন আলী তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলে তাদেরকেও এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করে। এ সময় স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ প্রতিবেশী ক’জন তাদেরকে উদ্ধার করে। ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অপবাদের শিকার রাহেনা বেগম বলেন, গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর রফিকুল ইসলাম ও মঞ্জুরুল ইসলাম পর্নো ভিডিওতে তাকে দেখা গেছে এমন কথা বলে তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। রেহানা এর প্রতিবাদ করলে তারা ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। ভিডিওর মেয়েটি নাকি আমার মতোই দেখতে। এ নিয়ে গ্রামের লোকজন ৩ জানুয়ারি সালিশ ডাকে। তাতে এলাকার ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন, মাতব্বর আবু বকর সিদ্দিকসহ অন্যরা ওই পরিবারকে একঘরে রাখার সিদ্ধান্ত দেন। এভাবে ছয় মাস কাটার পর এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১০ জুলাই রেহেনা ফের প্রতিবাদ করলে তাকে ও তার বাবাকে ধরে মাতব্বর আবু বকরের বাড়িতে নিয়ে পেটানো হয়।

সালিশের ঘটনা জানার কথা স্বীকার করে চিরিরবন্দর থানার ওসি আনিছুর রহমান বলেন, ”ভিকটিম পরিবারের পক্ষে এতদিন কোনো অভিযোগ না করায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারিনি।”

ঘটনাটি সাংবাদিকরা জানার পর ২৪ জুলাই এনামুল হক নয় জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন। মামলার পর এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে রবিবার আতাব আলী নামে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

রেহেনার বাবা এনামুল জানান, জুম্মার নামাজের পর তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে পেটানোর পর বিকালে ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন ঘটনাস্থলে এসে এসব নিয়ে কোথাও অভিযোগ করা যাবে না মর্মে তিনটি সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দেন। সে সময় তাদের ফের সমাজে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি। মারধরের কথা স্বীকার করে মাতব্বর আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ”তারা আমাদের গালাগালি করায় পারিবারিকভাবে শাসন করেছি। এটা আমাদের ভাই-ভাতিজার বিষয়।”

তবে ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন বিচার বসানোর কথা স্বীকার করলেও মারধর, একঘরে করা ও ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর