যেসব আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তায় ভূগছে বিএনপি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সম্পদ গোপন রাখার অভিযোগে ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের করা এক মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক হুইপ মশিউর রহমানকে সম্প্রতি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

একই অভিযোগে পৃথক আরেক মামলায় ঝিনাইদহ-১ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি এম এ ওহাবকেও দেওয়া হয়েছে আট বছরের সাজা। দুটি মামলারই বাদী দুর্নীতি দমন কমিশন।

ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের হওয়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিচার প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে। প্রতি সপ্তাহেই তিনি দৌড়াচ্ছেন আদালতে।

বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে গত বৃহস্পতিবার হাজিরা দেওয়ার পর আবার ৯ নভেম্বর নতুন তারিখ ধার্য হয়েছে। এরই মধ্যে নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া অর্থ পাচারের এক মামলায় উচ্চ আদালতে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাত বছরের সাজা হয়েছে।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার সাজা হয়েছে ১৩ বছর। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ডাদেশ।

সাজা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনেরও। বিএনপিতে এখন রাজনৈতিক মামলার চেয়ে ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে বেশি দুর্ভাবনা।

ওই সময়ে নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা সচল করা হচ্ছে। এগুলো দীর্ঘদিন হাই কোর্টে স্থগিত ছিল। দলের নেতারা বলছেন, ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ৬ হাজার মামলা হয়েছিল। বর্তমান সরকার সব মামলা বাতিল করে দেয়। কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৭ হাজারের বেশি মামলা চালু রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের হওয়া মামলাগুলো নতুন করে সচল করা হয়েছে। আমাদের চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধেও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা বিচারাধীন।

তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে হাই কোর্টে আসার আগেই মামলাগুলো টিকবে না। এর পরও কোনো কারণে হাই কোর্টে এলেও তা বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে নির্বাচনে লড়াই করার সুযোগ আছে।

তবে বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা এও আশঙ্কা করছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার প্রক্রিয়াও অনেক দূর এগিয়েছে। রায়ের দিনক্ষণ খুব একটা দূরে নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়ারও সাজা হতে পারে।

সাজা হলে খালেদা জিয়াকেও আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। পরে জামিন চেয়ে আপিল করতে হবে। সরকার হার্ডলাইনে থাকলে তাকেও জেলের ঘানি টানতে হবে। বিএনপি-প্রধান হতে পারেন নির্বাচনেও অযোগ্য।

তাদের মতে, জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় নিম্ন আদালতে সাজা হলে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বেগম খালেদা জিয়া। এতে নির্দোষ বলে রায় পাওয়ার আশা করছেন বিএনপি-প্রধানের আইনজীবীরা। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে করণীয় নিয়েও ভাবা হচ্ছে।

এদিকে এক মামলায় সাজা হওয়ায় তারেক রহমানকে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। তারপর জামিন চাইতে হবে। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা শঙ্কার কথা জানিয়েছেন খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও।

গত বৃহস্পতিবার বিশেষ আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আমাকে সরাতে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য “নীল নকশা” প্রণয়ন করছে বর্তমান সরকার। তারই অংশ হিসেবে আমার বিরুদ্ধে এ মামলা দেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও নেতারা হুমকি দিচ্ছেন, আমাকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় করে দেওয়া হবে। মামলা শেষ হওয়ার আগেই বিচার নিয়ে কথা বলছেন, মুখে মুখে রায় দিয়ে দিচ্ছেন তারা। তারা বলছেন, এ মামলায় আমার সাজা হয়ে যাবে। এসব বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল। এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমি এ মামলায় আদৌ ন্যায়বিচার পাব না।’

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, সরকার ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের হওয়া স্থগিত মামলাগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনরুজ্জীবিত করছে। দলের সিনিয়র পর্যায়ে অন্তত দুই ডজন নেতাকে সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করার ষড়যন্ত্র করছে সরকার।

এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি-প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মামলা চলছে রকেট গতিতে। সিনিয়র সব নেতার মামলাগুলো সচল করা হয়েছে। নেতাদের সবাই দৌড়াচ্ছেন আদালতে।

জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেনে দুদকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা মামলায় আসামিরা হলেন : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, তরিকুল ইসলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাহ উদ্দিন আহমেদ; ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, বরকত উল্লা বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, মোসাদ্দেক আলী ফালু, মিজানুর রজমান মিনু, আমান উল্লাহ আমান, এ কে এম মোশাররফ হোসেন; মজিবর রহমান সরোয়ার, এহছানুল হক মিলন, অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, নাদিম মোস্তফা, হারিছ চৌধুরী, আলী আসগার লবী, লুত্ফুজ্জামান বাবর, সালাহউদ্দিন আহমেদ (ডেমরা), ডা. দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন প্রমুখ।

তাদের প্রায় সবার মামলাই এখন সচল। গুটিকয় মামলা স্থগিত থাকলেও সেগুলো সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানান, সারা দেশে ৩৫ হাজার মামলায় দলের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ নেতা-কর্মী আসামির কাঠগড়ায়।

এর মধ্যে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধেই ওয়ান-ইলেভেনের মামলার খড়্গ ঝুলছে। বাকিগুলো এ সরকারের দুই মেয়াদের রাজনৈতিক মামলা। খুন ও অপহরণ করা হয়েছে ৪৩৬ জনকে। এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ গুম করা হয়েছে ২৭ জনকে। এর মধ্যে ১২ জনই ঢাকা মহানগরী ছাত্রদলের নেতা। সারা দেশে ১০ হাজারের ওপর নেতা-কর্মী কারাগারে রয়েছেন।

জানা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেই ৩৬ মামলা। নাইকো, গ্যাটকোসহ সব মামলাই চলছে সমানতালে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানহানিসহ শতাধিক মামলা। দুর্নীতির এক মামলায় তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকেও আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা।

দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে অভিযোগ গঠিত হয়েছে অন্তত ৪২টি মামলায়। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৮টি মামলার সব কটিতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ১৬ মামলার ৯টিতে, তরিকুল ইসলামের ১০ মামলার ৫টিতে, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার অর্ধশত মামলার ১৪টিতে, মির্জা আব্বাসের ৪৩ মামলার ২৮টিতে, গয়েশ্বর রায়ের ৩৫ মামলার ১৮টিতে ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৯ মামলার মধ্যে ৩টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে দলের যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ছাত্রদল সভাপতি রাজীব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই কমপক্ষে ২০০ করে মামলার খড়্গ ঝুলছে।

এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘মামলার গতিপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকারের নতুন কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে। আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের যেনতেনভাবে সরকার নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণায় মরিয়া। তবে আমরা হাল ছাড়ছি না। শীর্ষ নেতাদের নির্দোষ প্রমাণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ বিডি প্রতিদিন

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর