সেবার মানসিকতা নিয়ে আসলেও কেন আমাকে আহত হতে হবে- উত্তম কুমার বড়ুয়া

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অনেক আগের কথা। এখন আমার বয়স তিপ্পান্ন বছর। আমি চট্টগ্রামের রাউজানে বেড়ে উঠেছি। এটি বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা। আমার বাবা ছিলেন একজন প্রকৌশলী ও সরকারি কর্মকর্তা। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি তখন বাবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মারা যান। মায়ানমারের ইয়াঙ্গুনে তিনি কৃষি এগ্রিগেশন বিভাগে চাকরিরত ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি সেখান থেকে বাংলাদেশে আসেন। মা ছিলেন গৃহিনী। আমরা তিন ভাই ও এক বোন। বাবা মারা যাওয়ার পর মা ছিলেন আমাদের একমাত্র ভরসা। তিনি মেয়ের বিয়ে, তিন ছেলের পড়াশুনা সব মিলিয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। আমার বড় ভাই পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। ছোট ভাই একজন শিল্পী। সে ভাস্কর্য শিল্প নিয়ে কাজ করছে। আমি একজন চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের আজকের এ অবস্হানে আসার কৃতিত্ব পুরোটাই মা’র। এ জন্য আমি বলব আমার মা একজন গুণী মা। তিনিই আমাদের বাবা, তিনিই আমাদের মা।

ছোটবেলাটা আসলে খুবই স্মৃতি বিজরিত একটা মূহুর্ত। আমি ছোট বেলায় খুব একটা ডানপিটে ছিলাম না; আবার গোবেচারাও ছিলাম না; ছোটবেলা থেকেই বেশ চৌকষ ও চটপটে ছিলাম। আমাদের পড়াশুনার প্রতি বাবা-মা  খুবই সচেতন ছিলেন। ছোট্ট একটা গল্প বলি- আমি ছোট বেলায় ইংরেজিতে একটু দূর্বল ছিলাম। কিন্তু অঙ্কে বরাবরই ভালো করতাম। এ কারণে তার নির্দেশ ছিলো ইংরেজি বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্ত হবে। হুবহু তাকে পড়ে শুনাতে হবে। আমার বাড়ি থেকে স্কুলের দূরুত্ব ছিলো মাত্র এক-দুই মিনিটের পথ। আমাকে দশ মিনিট আগে পড়ার টেবিল থেকে ছাড়া হতো। এই সময়ের মধ্যেই গোসল ও খাওয়া শেষ করে স্কুলে যেতে হতো। বাবা মারা যাওয়ার পরও মায়ের শাসনে সেই শৃঙ্খলাবোধ আমরা সবসময় মেনে চলেছি।

গ্রামে শরতের শিশির, কাদামাটি, শিউলী ফুল, পাশেই হালদা নদী, শস্য ভরা মাঠ, পুকুর ভরা মাছ সবকিছুই আমাকে বিমোহিত করেছে। আবার হাডুডু, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, বর্ষাকালে কাদামাটিতে ফুটবল খেলা, যেমন- ষাঁড়ের লড়াই, মোড়গের লড়াই, বৈশাখী মেলা প্রভৃতি নিয়েও আমাদের অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে।

সবচেয়ে ভালো লাগতো যে বিষয়টি তা হলো হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। যা ছিলো দেখার মতো। তাদের মধ্যে আমরা কখনো বিভেদ দেখিনি। আমি মূলত সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মাঝে গড়ে উঠেছি। এখনো তা লালন করি ও বিশ্বাস করি। এ দেশ আমার, এ মাটি আমার, এ সংস্কৃতি আমার। এই চেতনায় বিশ্বাস করেই আমি এখনো এগিয়ে যাচ্ছি।

যেটা না বললে আমার হয় না, আমাদের ওখানে সে সময় একটা ছোট সংগঠন ছিলো। সেটির নাম ছিলো কচিকাঁচার মেলা। এটার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন দাদাভাই রোকনুজ্জামান ও বেগম সুফিয়া কামাল। প্রথমে আমি এটার সদস্য ছিলাম। তারপর উপদেষ্টা ও সংগঠক। মূলত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিকাশ ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার প্রকাশই ছিলো এটার মূল লক্ষ্য। সে সময় প্রতি রোববার দৈনিক ইত্তেফাকে ছোটদের লেখার জন্য কচিকাঁচার পাতা ছিলো। আমি ছোট বেলা থেকেই সেখানে লেখালেখি করতাম।

আমাদের পরিচালক ছিলেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু। তিনি আমাদের লেখাগুলো যাচাই করতেন এবং পত্রিকায় পাঠাতেন। তিনি একটা লেখা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রায় বিশবার কাটাকাটি করতেন।

আমার প্রতিভা মূলত সেখানেই বিকশিত হয়েছে। আমি স্কুলে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলাম। এছাড়াও ক্লাসের ক্যাপ্টেন, স্কাউটের প্রধান, খেলার গ্রুপ প্রধান ছিলাম। নেতৃত্বের গুণাবলি আমার মাঝে ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছে।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন ?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: আমি গ্রামের স্কুল থেকেই এসএসসি এবং চট্টগ্রাম মহসীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করি। আমি ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে চলে আসি। প্রথমে সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। এরপর আমি  অটোমাইগ্রেশনের মাধ্যমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে যাই। সেখানে আমি রাজনীতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর একনিষ্ঠ  কর্মীতে পরিণত হই। পরবর্তীতে দুবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। এরপর জেলা ছাত্রলীগে অন্তর্ভুক্ত হই এবং ভিপি পদে নির্বাচন করি। আমি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে  ময়মনসিংহ থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করি।

বিভিন্ন সময় আমি পুলিশি নির্যাতনের স্বীকার হয়েছি। প্রায় একযুগ আমি ময়মনসিংহে কাটিয়েছি। এমবিবিএস পাশ করার পর সেখানেই একটি এনজিওর অধীনে চাকরি শুরু করি। এরপর আমি ঢাকাতে কিছুদিন একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি করি। ১৯৯৭ সালে আমি সরকারি চাকরিতে যোগদান করি মেডিকেল অফিসার হিসেবে। এখন আমি রেসপেরিটরি মেডিসিনের অধ্যাপক এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ এর পরিচালক। আমি বিএসএমএমইউ’র আন্ডারে বক্ষব্যাধি ইনসস্টিটিউট থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেছি। আমেরিকান কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে ফেলোশিপ ডিগ্রী (FCCP) অর্জন করেছি। এখন আমি পিএইচডি’তে অধ্যয়নরত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ্যাজমা ও হাঁপানীর একটি ড্রাগ এর প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করছি। এখনো শিখছি, শেখার শেষ নেই।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ আপনি দেশের অন্যতম সেরা হাসপাতালের পরিচালক। এখানে সেবার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছেন ?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: চিকিৎসাসেবা একটি মহৎ পেশা। এটি কোনো বক্তব্য বা স্লোগান না। ছোটবেলায় শিক্ষকরা আমাকে প্রশ্ন করত। বড় হয়ে কী হতে চাও? বলেছি: চিকিৎসক হতে চাই। কেন হতে চাও? মানুষকে সেবা দিতে চাই। তখন কতটুকু বুঝেছি জানিনা, তবে এখন বুঝি। আপনি যদি এই পেশায় আসতে চান তাহলে আপনাকে এটা বুকে লালন করতে হবে। যদি আমরা বাহ্যিকভাবে মনে করি, আমি একটি ভালো চাকরি করব, লোকে আমাকে সম্মান করবে, সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়াবো, গাড়ি-বাড়ি করব, এ ধরনের চিন্তা যাদের আছে তাদের এই পেশায় আসা উচিত না।

যে চিকিৎসক হতে চায় তার ভিতরে মানবিকতা, সেবার গুণ, সেবা দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। যদি এই গুণগুলো কারো মাঝে না থাকে তাকে চিকিৎসক হতে আসা উচিত না। আমাদের অনেকের মাঝে এই সমস্যাগুলো থাকার কারণেই ঠিকমতো সেবা দিতে পারি না। আমি পরিচালক হিসেবে তিনটি কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।

এক. আমি একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও শিক্ষক। আমি বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ হওয়াতে আমার প্রধান কাজ বক্ষব্যাধি রোগীদের সেবা দেয়া। তাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা।

দুই. অধ্যাপক বা শিক্ষক হিসেবে আমার কাজ ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেয়া।

তিন. আমি একটি হাসপাতালের কর্ণধার। এই হাসপাতালের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রশাসনিক বিভাগ, সেবার মান সবকিছু দেখাশুনা করা আমার দায়িত্ব।

আমি দুবছর ধরে এই হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে আছি। আমি এ দায়িত্বটি  উপভোগ করছি। সরকার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। আমি তা শতভাগ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। এছাড়াও বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করতে হয়। বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজের সাথেও আমি জড়িত। আমার অনেক গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকগুলো প্রকাশনাধীন আছে।

একসময় সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। আমরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের আস্হা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। ইতোমধ্যেই এটি একটি জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে নিজের অবস্থা দৃঢ় করেছে। এখানে অন্যান্য হাসপাতালের মতো মেডিসিন, সার্জারি, গাইনী, শিশু, অর্থো, গ্যাস্ট্রো, নেফ্রো, নিউরো, ইউরোসহ আরো বেশ কিছু বিভাগ আছে। সেবার উৎকর্ষতা সাধনের জন্য যা করা দরকার তা আমরা নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের এটি ৮৫০বেডের হাসপাতাল হওয়া সত্বেও প্রতিদিন গড়ে ১৪শ রোগী ভর্তি থাকে। সবাইকে আমরা বেড দিতে পারছি না; হিমশিম খাচ্ছি।

রোগীদের দুটো উপলব্ধি আমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এক. হাসপাতালে যতোই ভালো চিকিৎসা হোক যদি বাথরুমে গন্ধ থাকে তাহলে রোগীদের মন্তব্য হলো এখানে কোনো চিকিৎসাই হয় না। অথচ তারা বাইরে যে অপারেশন করছে একই অপারেশন আমার হাসপাতালেও করা হচ্ছে। তাই আমার হাসপাতাল ২৪ঘন্টা পরিস্কার থাকে। অন্য কোনো সরকারি হাসপাতাল থাকে কি না সে প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। আমার হাসপাতাল অন্যান্য প্রাইভেট কর্পোরেট হাসপাতালের মতো সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে।

দুই. আপনি রোগীর সাথে কী ব্যবহার করছেন। আমাদের হাসপাতালে এটিকে আমরা অনেকটা কমিয়ে এনেছি। এটির জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া, কাউন্সিলিং, ট্রেনিংসহ বিভিন্ন কাজে আমরা হাতে নিয়েছি। এক সময় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। এগুলো আমরা কমিয়ে এনেছি। শতভাগ না হলেও আমরা চেষ্টা করছি।

আমরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে শতভাগ দালালমুক্ত করেছি। হাসপাতালগুলোতে অনেক চক্র কাজ করে। এটি বাংলাদেশের একটি সাধারণ চিত্র। আমরা এ সকল দালালচক্র ভেঙে দিয়েছি। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি এই চক্রের সাথে আমার হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী, নার্স, ডাক্তার জড়িত নেই। দালাল নির্মূলের ক্ষেত্রে আমি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই।

অনেক হাসপাতালে রোগীর বেড নিতে, কেবিন পেতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাড়তি টাকা লাগে। অবশ্য দুর্নীতি শুধু হাসপাতালেই না দেশের প্রায় সব বিভাগেই এ সমস্যাটা আছে। এটাও আমরা রোধ করেছি। ছোটখাট বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও টাকার বিষয়ে বর্তমানে কোনো অভিযোগ নেই। আমরা মাইকিং করে হাসপাতালে এসে সাধারণ জনগণকে কোথায় কী করতে হবে তা জানিয়ে দিয়েছি। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি পরিচালক বা সহকারি পরিচালক বরাবর অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে।

আরেকটি ভালো কাজ আমরা করেছি। যেটির পুরোপুরি অটোমেশন আমরা করতে পারিনি। আমরা ওয়ান স্টপ ক্যাশ কাউন্টার’ চালু করেছি। যার মাধ্যমে রোগীরা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অর্থের বিবরণী একসাথে পেয়ে যাবে। এটি প্রাইভেট হাসপাতালগুলো করে থাকে। এটি আমরা সরকারের আর্থিক আনুকূল্য ছাড়াই চালু করেছি। এগুলোর কারণে মানুষ আস্হার জায়গায় ফিরে এসেছে।

একজন রোগীর জন্য মানসিক ও শারিরীক দুটো অবস্হারই উন্নতির প্রয়োজন। এ কারণে আমরা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সুন্দর দুটো ‘বাগান’ করেছি। যেখানে রোগীরা হাটাহাটি ও বিশ্রাম নিতে পারবে।

আমার এখানে একটি ‘টেলি মেডিসিন সেন্টার’ আছে। এই সেন্টার বাংলাদেশে মোট ৬৮টি আছে। যে রোগীরা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদেরকে বিশেষ তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেয়ায় এটার কাজ।

অটিস্টিক শিশুদের জন্য আলাদা ব্যবস্হা আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা ব্যবস্হা আছে। যক্ষা ও কুষ্ঠ রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্হা আছে। এ ছাড়াও আমরা বিভিন্ন ক্লিনিক রেখেছি। যেমন- ডেঙ্গু ক্লিনিক, চিকনগুনিয়া ক্লিনিক, অ্যাসমা ক্লিনিক, কলোরেক্টাল ক্লিনিক, ব্রেস্ট ক্যান্সার ক্লিনিক, সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার ক্লিনিক। এগুলো সপ্তাহে একদিন বা দুদিন সেবা দিয়ে থাকে।

আমরা কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট করতে বেশ কিছু কাজ করেছি। এখানে মোট ৪৩টি টিম রয়েছে। প্রতিটি টিমে ৮জন সদস্য রয়েছে। প্রতি মাসে আমরা বৈঠক করি। বৈঠকে আপনি রোগীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন কীনা, করলে কেন করেছেন ? এগুলো বিষয়ে আলোচনা হয়।

আমাদের এখানে এমসিসিওডি আছে। অর্থাৎ আমরা যে ডেড সার্টিফিকেটগুলো দেই তা ডাটা প্রসেসিং এর মাধ্যমে দিয়ে থাকি। সেখানে মৃতের পূর্ণ বিবরনী দেয়া থাকে। সম্প্রতি আমাদের হাসপাতালে পোস্ট মর্টেমও চালু হয়েছে। ডিজাস্টার ম্যানেজনমেন্টের জন্য আমার একটা কমিটি আছে। ইমারজেন্সি ক্যাজুয়ালিটির জন্য একটা টিম রয়েছে।

এখানে কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। প্রত্যেকের সহযোগিতায় কাজের সুন্দর পরিবেশ রয়েছে। তাদের নিরাপত্ত্বা নিশ্চিত করতেও আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা ৬৮টি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে হাসপাতালের সকল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকি। শুধু তাই নয় আমাদের একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং সেল আছে। যেখানে চব্বিশ ঘন্টা কর্তব্যরত ব্যক্তি সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

এ কাজগুলো করার কারণে আমরা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহলের প্রশংসা অর্জন করেছি। ২০১৫ সালে আমরা ‘বেস্ট অ্যাওয়ার্ড ইন গভমেন্ট সেক্টর’ লাভ করেছি। ২০১৬ সালেরটাও আমরা পাব বলে আশা করছি।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ সম্প্রতি হাসপাতালে ক্যান্সার ওয়ার্ড চালু হওয়ার কথা শুনলাম। কবে নাগাদ শুরু করতে পারবেন?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: হ্যা, সম্প্রতি আমরা ক্যান্সারের রোগীদের জন্য একটি বিশেষ ওয়ার্ড চালু করছি। এটা মূলত তার্কি ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেটিভ অ্যাজেন্সি (টিকা) এর অর্থায়নে হচ্ছে। এটা ষাট বেডের একটি ওয়ার্ড হবে। এটি পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হবে। কাজ প্রায় শেষের দিকে। আগামী দু মাসের মধ্যেই  এটি আমরা চালু করতে পারব। এরই মধ্যে তারা আমাদের একটি এম্বুলেন্স দিয়েছে।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ হাসপাতালগুলোতে কাংক্ষিত চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে ?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: একটি হাসপাতালে চব্বিশ ঘন্টা ইমার্জেন্সি চালু থাকতে হবে, সকালবেলা বহির্বিভাগ থাকতে হবে, ২৪ঘন্টা সার্জারি করার সুযোগ থাকতে হবে, ক্যাজুয়ালটি বিভাগ থাকতে হবে, আইসিইউ থাকতে হবে। আমাদের ১০ শয্যার আইসিইউ থাকলেও শিশুদের জন্য এনআইসিইউ নেই। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম আমার আছে। ডায়ালাইসিস এর জন্য আমাদের চারটি বেড আছে।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ হাসপাতাল নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা কী ?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: পরবর্তী যে পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। এই। ৮৫০ শয্যার তিনতলা হাসপাতালটিকে আমরা ১৬০০ শয্যার হাসপাতাল করতে চাই। আমরা ইতোমধ্যেই সরকারের স্বাস্হ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ফাইভ ইয়ারস অপারেশনাল প্ল্যান এর মাধ্যমে ২৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। আমরা ৩তলা কে ৬ তলায় বর্ধিত করব। এবং আরেকটি ১০ তলা মাল্টিপারপাস বিল্ডিং এর অনুমোদন আমরা পেয়েছি। পিডব্লিউডি এটার বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে। ইতোমধ্যেই তারা টেন্ডার করেছে। আমরা আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।

আমরা আইসিইউতে আরও ১০টি শয্যা বাড়াব এবং ১০ শয্যার এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) তৈরি করব।  আমাদের কিচেন ব্যবস্হা ১০ তলায় করবো, ইন্টার্ণ ডাক্তারদের জন্য হোস্টেল করব। লন্ড্রীর ব্যবস্হা করবো। সিএ রেজিস্ট্রারদের জন্য একটা ফ্লোর থাকবে। একটি আধুনিক ট্রেনিং সেন্টার থাকবে। একটি অডিটরিয়াম থাকবে।

আমরা পুরো হাসপাতালটিকে অটোমেশন করতে চাই। আমরা এটি আংশিকভাবে চালু করেছি। এ বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনা চলছে। যদি সরকার অনুমোদন দেয় তাহলে তাহলে এ হাসপাতালের জন্য একটি পাইলট প্রজেক্ট হবে। এই হাসপাতালে আমরা একটি মডেল ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স করতে চাই। যা বাংলাদেশের কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে নেই।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ চিকিৎসকরা ক্রমশ রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছেন। বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: রাজনীতি মানুষের অধিকার। একজন মানুষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষক, শ্রমিক যাই হোক না কেন তার রাজনীতি সচেতনতা থাকা চাই। চিকিৎসকদের এ রাজনীতি সচেতনতা বৃদ্ধিকে আমি সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে যাতে আমরা রাজনীতি করতে গিয়ে নিজেকে যেন অপরাজনীতির সাথে জড়িয়ে না ফেলি।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ ‘নির্যাতিত চিকিৎসকদের পাশে চিকিৎসক নেতারা দাড়ায় না’ এ অভিযোগকে আপনি চিকিৎসক নেতা হিসেবে কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: আমরা লক্ষ্য করছি, নির্যাতিত চিকিৎসকরা চিকিৎসক নেতাদের অভিযুক্ত করছেন। এটির পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য আছে। যে অভিযোগ উঠছে তা অমূলক না আবার নেতারাও যে কিছুই করছেন না তাও ঠিক না। এখানে ভুল বুঝাবুঝির একটা ব্যাপার আছে। তবে এটা ঠিক আমাদের সব ক্ষেত্রেই যেমন নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। আমরা চিকিৎসকরা বারবার আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছি। আমি যদি সেবার মানসিকতা নিয়ে আসি তারপরও কেন আমাকে আহত হতে হবে, নিরাপত্তাহীন হতে হবে? এগুলো কখনো আমরা প্রশাসন থেকে পাই আবার কখনো রোগীর অ্যাটেন্ডেন্টদের কাছ থেকে পাই। একজন পুলিশ যদি আহত হয় তাহলে আইন আছে গ্রেপ্তার করার, সাংবাদিক যদি আহত হয় তাহলে সে কলম দ্বারা লিখতে পারবে, আইনজীবী যদি আহত হয় তাহলে সে কোর্টে মামলা করতে পারবে। এ ধরনের প্রত্যেক পেশার একটা কাভারেজ আছে। কিন্তু চিকিৎসকদের নেই। আমাদের ক্ষেত্রে বলে, আপনি সেবক আপনি হাত তুলতে পারেন না, আপনাকে সবকিছু সহ্য করতে হবে, আপনি আন্দোলন করতে পারবেন না, ধর্মঘট করতে পারবেন না। আসলে প্রতিটা মানুষ তাদের নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সরব; শুধুমাত্র চিকিৎসকরাই অসহায়।

আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন লেভেলে মহিলা ডাক্তারদের টেনে হিচড়ে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষন করা হয়েছে। কতোজনকে আমাদের বিচার বিভাগ অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন, রোগী মারা গেলেই সাংবাদিক বন্ধুরা লিখছে ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেছে। ভুল চিকিৎসার নির্ধারক কি আমার সেই সাংবাদিক বন্ধু?

আমাদের তরুণ চিকিৎসকরা যখন আমাদের কাছে অভিযোগ করে তখন আমাদের একটি বিষয় করার থাকে। আমরা ধর্মঘট করতে পারি, প্রতিবাদ লিখতে পারি। নিশ্চয়ই একজন ডাক্তার দায়িত্বশীল পদে থেকে হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় নামলেই সব কিছুর সুরাহা হয়ে গেল তা কিন্তু না। তরুণ চিকিৎসকদের এ ধরনের এ ধরনের আশা ঠিক না।

নিশ্চয়ই আমরা প্রতিবাদ করব। তারও একটা সীমারেখা থাকতে হবে। জনগণ কী বলছে, আমরা কী করছি এটাও ভেবে দিখতে হবে। আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক, নার্স-রোগী সম্পর্ক, ডাক্তার-অ্যাটেন্ডেন্ট সম্পর্ক এখানেই আমাদের অনেক ধরনের ঘাটতি রয়েছে।

প্রথমে নিজেরটাই বলি, একজন চিকিৎসক বা নার্স সরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন পাশাপাশি প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করছেন। আমাদের প্রতি এ অভিযোগ তো আছেই। তবুও আমাকে ভাবতে হবে সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সাথে আমরা যে ব্যবহার করছি, প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকেও কি রোগীদের সাথে একই ব্যবহার করছি।  ঐখানে আমি রোগীকে বাবা ডাকছি, সরকারি হাসপাতালে তাদের সাথে কথাই বলছি না!

এখন আসুন রোগীর ক্ষেত্রে, সে প্রাইভেট ক্লিনিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করছে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে আসলে তার আচরণ সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা শুধু নিজের দিকটাই দেখতে চায়। এতো রোগীর চাপ; আমাদের সীমাবদ্ধতা তারা মানতে চান না। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোকেও  দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যতোক্ষণ না আমরা সবাই সংশোধন হবো এ সমস্যার সমাধান হবে না।

আমি মনে করি নেতাদের নিয়ে তরুণ চিকিৎসকদের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের যে জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার আমরা সে জায়গাতে ব্যর্থ। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ভালো কিছু করার।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ পাবনার ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলুন।

উত্তম কুমার বড়ুয়া: এটি সরকারি কর্মকর্তাদের একটি ভুল বোঝাবুঝি। ডিসি বলছেন, আমি তাকে ফোন করে ডাক্তার পাঠাতে বলেছি উনি ডাক্তার পাঠাননি এবং কর্কশ ভাষায় কথা বলেছেন।

ডা. মঞ্জুরা বলছেন, আমাকে ডিসি ফোন করেন নি। অফিসের একজন কর্মকর্তা আমাকে ফোন করেছেন। আমি বলেছি, আমি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছি ওনাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিন। এখানে অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন। প্রয়োজনে চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিব।

এটা সামান্য ভুল বুঝাবুঝি। দুজনেরই উচিত একটা সমঝোতায় আসা। এটার একটা সুরাহা হয়ে যাওয়া উচিত।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ কোনটা বেশি উপভোগ করছেন পরিচালক নাকি চিকিৎসক ?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন মানুষ। দ্বিতীয়ত আমি চিকিৎসক। মূলত আমি দুটিকেই উপভোগ করি। আমি আমার সকল দায়বদ্ধতা পুরোপুরি পালন করতে চাই।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ মেডিভয়েসের পথচলাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

উত্তম কুমার বড়ুয়া: সাংবাদিকে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছে এটা আমরা লক্ষ্য করেছি। সাংবাদিকের মাধ্যমে অনেক অজানা তথ্য বেড়িয়ে আসে। আমি মনে করি সাংবাদিকের এ উদ্যোগ অত্যন্ত সুন্দর। আমরা লক্ষ্য করেছি গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তগুলোতে এটি বেশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে আসছে। আমি সাংবাদিকের  এর উত্তরোত্তর মঙ্গল কামনা করছি। যদি কখনো প্রয়োজন হয়, সহযোগিতা লাগে তাহলে আমি প্রস্তুত।সাংবাদিকের  চিকিৎসকদের কথা, অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করবে এটিই আমার প্রত্যাশা। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকুক এটিই আমার প্রত্যাশা।

সাংবাদিকের প্রশ্নঃ এতো ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

উত্তম কুমার বড়ুয়া: আপনাদেরও অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে সাংবাদিকের কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। সাংবাদিকে এগিয়ে চলুক, আমরা সাংবাদিকের সাথে আছি।

সূত্রঃ মেডিভয়েস

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর