রোহিঙ্গাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই ভরসা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের একটি মুদি দোকানে বসে আছেন রোহিঙ্গা মমতাজুল হক। কাজের ফাঁকে তিনি মোবাইল ফোনটি হাতে নিলেন। তারপর নিবিষ্টমনে শুনতে লাগলেন একটি অডিওবার্তা। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার পাশে বাচ্চা ও বয়স্ক রোহিঙ্গাদের ভিড় জমে গেল। সবাই উৎসুকভাবে শুনছে তার হাতের মুঠোফোন থেকে ভেসে আসা অডিওবার্তা। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমির খবর নিতে নির্ভর করতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর।

এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। হোয়াটসঅ্যাপে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ সংক্রান্ত একটি অডিওবার্তা শুনছিলেন মমতাজুল হক। তিনি বলেন, আমি এগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনি। কারণ, এ থেকেই আমার মাতৃভূমির বর্তমান অবস্থা জানতে পারি। মমতাজুল নামের এই রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছেন ১৯৯২ সাল থেকে। সে সময়ে সংগঠিত নৃশংসতার জেরে তিনি পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আর মিয়ানমারে ফেরত যাননি। থেকে গেছেন বাংলাদেশেই। ওই সময়ে তার সঙ্গে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গাই আর ফেরত যাননি। তবে সামপ্রতিক সময়ের রোহিঙ্গা নিধন অভিযানের কারণে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরগুলোতে। ২৫শে আগস্ট নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর কমপক্ষে ৬ লাখ নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এ নিয়ে দেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো প্রায় ১০ লাখ। এসব রোহিঙ্গার নিজের মাতৃভূমির খোঁজ নেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবের মতো আ্যপগুলো এখন তাদের সামাজিক খবর সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে, হোয়াটসঅ্যাপে ডজনখানেক সক্রিয় গ্রুপ নিয়মিত মিয়ানমার সংক্রান্ত খবরাখবর প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তারা সেখানে চলমান সহিংসতার ভিডিওচিত্র থেকে শুরু করে এ কারণে নিখোঁজ হওয়া লোকজনের তালিকা পর্যন্ত প্রকাশ করছে। এমনকি পড়াশোনা জানা রোহিঙ্গাদের জন্যে কিভাবে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে, এ সংক্রান্ত নির্দেশনাও দিচ্ছে। তবে, রোহিঙ্গাদের তথ্য সংগ্রহের এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন যোগাযোগ মাধ্যমের বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই এসব মাধ্যমে ভুয়া অথবা আংশিক সত্য সংবাদ প্রকাশ করা হয়। কখনো কখনো মনগড়া আক্রমণের খবর ছড়িয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হয়। এসব সংবাদের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখার দরুন তথ্যবিভ্রাটে ভুগতে হয় রোহিঙ্গাদের। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যার ইচ্ছে সে-ই সংবাদ প্রকাশ করতে পারছে। এমন গ্রুপে রয়েছে শত শত মানুষ। তাদের উদ্দেশ্য কিংবা পরিচয় সবই গোপন থাকছে। এর ফলে যে যা খুশি খবর হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। এভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করা কিংবা ক্ষেপিয়ে তোলা অত্যন্ত সহজ। এটি একটি ঝুঁকিপূর্র্ণ প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। অনুসন্ধানে এ দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে। অনেক রোহিঙ্গা স্বীকার করেছেন, তারা এসব মাধ্যমে নিয়মিতই ভুয়া সংবাদ পান এবং তা অযাচিত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত খবর প্রকাশের সুযোগ ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ অশনিসঙ্কেত। হতে পারে খবর প্রকাশ করা নয় বরং এজেন্ডা ছড়ানোর অভিপ্রায়ে এসব গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হচ্ছে এবং মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। এ ধরনের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ব্যবহার করেই আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)’র সদস্যরা সংগঠিত হয়ে সেনাবাহিনীর ওপর ২৫শে আগস্ট চালানো হামলার পরিকল্পনা করে। তাই, বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে খবরের জন্যে রোহিঙ্গাদের এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভর করাকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি এর ফলে যাতে কোনো সংঘাত না ছড়ায় সেদিকেও নজরদারি করতে হচ্ছে। তবে, বাস্তবতা হলো এগুলোই এখনো মাতৃভূমির খবর নেবার জন্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মূল ভরসা। মমতাজুলের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়, আমরা রোহিঙ্গারা সংগঠিত নই। হতাশা প্রকাশের জন্যে এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর