বাঙালী মুরগির ঝোলের জাপান জয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ভারতের ভাইসরয়, যাকে বড়লাট বলেই সাধারণ মানুষ সম্বোধন করতেন, লর্ড হার্ডিঞ্জ আর লেডি হার্ডিঞ্জ হাওদায় চেপে বেড়াতে গিয়েছিলেন দিল্লির চাঁদনি চক এলাকায়। সঙ্গে বহু লোক লস্কর। হঠাৎই প্রচণ্ড আওয়াজ। বড়লাটের হাওদায় এসে পড়ল একটি বোমা।

বিস্ফোরণে বড়লাটের কাঁধ, পিঠ, পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। মাথায় ঢুকে গেছে বোমার স্প্লিন্টার। মাহুত সেখানেই মারা যান, তবে লেডি হার্ডিঞ্জ অক্ষত ছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে পুলিশ শুরু করল কারা চালালো বড়লাটের ওপরে এই হামলা।

হামলার মূল নায়ক হিসেবে নাম উঠে এলো এক বাঙালী বিপ্লবীর। রাসবিহারী বসু। গ্রেপ্তার হলেন বেশ কয়েকজন, কিন্তু রাসবিহারীকে খুঁজে পেল না পুলিশ। গা ঢাকা দিয়ে ভারতেই ছিলেন তিনি। আর তলে তলে আরো অনেকের সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করছিলেন দেশব্যাপী এক সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়ে ব্রিটিশদের ভারত ছাড়া করার। ১৯১৬ সালে সেই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেল, শুরু হল লাহোর ষড়য্ন্ত্র মামলা।

এবারে দেশ ছাড়লেন রাসবিহারী বসু। পাড়ি দিলেন জাপানে। আশ্রয় নিলেন অতি প্রভাবশালী এশিয়-জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ তোওমা মিৎসুরু-র কাছে। তবে ব্রিটিশ পুলিশ খোঁজ পেয়ে গেল মি. বসুর। কিন্তু তাদের সাহস হয় নি মিৎসুরু-র বাড়িতে ঢুকে তল্লাশী চালানোর।

জাপানিজ পার্সপেক্টিভ ওয়েবসাইট লিখছে, “বিপদ আঁচ করে রাসবিহারী বসুকে সরিয়ে দেওয়া হল তোওমার বন্ধু সোওমা আইজোর বাড়িতে টোকিওর শিঞ্জিকু এলাকায়। তারা একতলায় `নাকামুরায়া` নামের একটি বেকারী চালান। সুস্বাদু রুটি তৈরী হয় সেখানে।

১৯০১ সালে তৈরী ওই দোকানটির নাম-ডাকও ছড়িয়ে পড়ে। তারই ওপর তলায় একটি ঘরে থাকতে শুরু করেন মি. বসু। “পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে জন্ম নেওয়া রাসবিহারী বসু তখন সোওমা পরিবারের কাছে হয়ে উঠেছেন শুধু বেহারী বোস।

আশ্রয়দাতার কন্যার প্রেমে পড়লেন বেহারী বোস। বিয়েও হল একটা সময়ে বসুর সঙ্গে সোওমা তোশিকোর। কিন্তু ১৯২৫ সালে মি. বসু স্ত্রীকে হারালেন যক্ষায়। “বছর দুয়েক পরে শ্বশুর-শাশুড়ীকে বেহারী বোস প্রস্তাব দিলেন যে রুটির পাশাপাশি তিনি মুরগির ঝোল বা কারি আর ভাতও বিক্রি করতে চান বেকারীতে।

জামাইয়ের প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলেন আইজো। দোতলায় একটি রেস্তোরা তৈরী করালেন। ভারতীয় কারি আর ভাত বিক্রি শুরু হল সেখানে,” জানাচ্ছিলেন জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রবীর বিকাশ সরকার।

দোকানের নামেই মুরগির ঝোল-ভাতের এই নতুন পদের নাম দেওয়া হয়েছিল নাকামুরায়া চিকেন কারি। তার আগে জাপানে যে মুরগি কারি বিক্রি হতো, তা মূলত ব্রিটিশ পদ্ধতিতে তৈরী। বেশ জনপ্রিয়ও ছিল রান্নার সুবিধার জন্য। ৫০ বছরেরও বেশী সময় ধরে নাকামুরায়ার প্রধান শেফ নিনোওমিয়া তাকেশি ওই কারি পরিবেশন করেছেন।

নিপোন্নিয়া ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছিলেন, “জাপানে কারির প্রচলন হয় ১৯১০ সাল নাগাদ। রাইসু কারি বা কারি রাইসু নামের সেই মুরগি ঝোল ভাত প্রথমে বড় রেস্তোঁরা, তারপরে শহরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। মাংসের থেকে সবজিই বেশী থাকত সেটায়, ঝোলটা গাঢ় করা হতো ময়দা মিশিয়ে। ভাতের সঙ্গে খাওয়া হতো  সেটা। এখনো প্রচলিত আছে সেই রেসিপি। কিন্তু রাসবিহারী বসুর পদ্ধতিতে আমরা যে কারি তৈরী করি, সেটা রাইসু কারি থেকে অনেকটাই আলাদা।”

যারা টোকিওতে গিয়ে নাকামুরায়া চিকেন কারি খেয়েছেন, তাদের কথায় ভারতীয় মুরগির ঝোলের থেকে এই কারি-র স্বাদ কিছুটা ভিন্ন। কড়া রং নেই, পাতলা ঝোলও থাকে না। বেশ ঘন। কিন্তু খুবই সুস্বাদু আর সুগন্ধী এই বাঙালী মুরগির ঝোল-ভাত। শেফ তাকেশি একটি সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, “আমরা ময়দা মিশিয়ে ঝোলটা গাঢ় করি না। সবজি সেদ্ধ হতে হতেই ঝোল ঘন হয়ে যায়। হাল্কা স্বাদের এই কারিতে এমন সব মশলা মেশানো হয়, যেগুলোর ভেষজ গুণও রয়েছে, তাই নিয়মিত খেলেও স্বাস্থ্যহানির কোনো আশঙ্কা থাকে না।”

মি. সরকার বলছেন, “বেহারী বোস জাপানীদের স্বাদ বুঝে গিয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি তাদের পছন্দ হবে, এরকমই কারি তৈরী করেছিলেন। সেজন্যই এতো বছর পরেও জাপানে অতি জনপ্রিয় এই নাকামুরায়া কারি। “এখনো জাপানের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নাকামুরায়া চিকেন কারির প্রসঙ্গ এলে রাসবিহারী বসুর কথাও উঠে আসে।

যদিও রেস্তোঁরার মালিকানা বদল হয়েছে, নতুন সাজে সেজেছে সেটি। কিন্তু এখনো সেখানে রাখা আছে রাসবিহারী বসু আর তর পত্নীর ছবি। রয়েছে একটি পুরণো পোস্টার।

`আমরা ভারতীয় কারি পরিবেশন করি, যেটা জাপানে নিয়ে এসেছিলেন এক ভারতীয় বিপ্লবী`।

মি. প্রবীর বিকাশ সরকার বলছিলেন, “ওখানে খেতে গিয়েই আমার চোখে পড়ে কয়েকটি ছবি – যার মধ্যে রাসবিহারী বসুর ছবিও ছিল। তারপরে জাপান টাইমস পত্রিকাতেও একটি প্রবন্ধ পড়ি, তারপরে কিছু গবেষণা করতে হয়েছে – বিহারী বসুর শাশুড়ি সোওমা কোক্কো`র আত্মকথা এবং সোওমা কোক্কো ও সোওমা ইয়াসুও-র লেখাপত্র নিয়ে পড়াশোনা করি। কীভাবে এক বাঙালী বিপ্লবীর হাত ধরে জাপানে মুরগির ঝোল ভাত এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল, সেই অনবদ্য কাহিনী জানতে পারি।

একদিকে যখন দিনকে দিন আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তার তৈরী ভারতীয় কারি, অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠিত করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন রাসবিহারী বসু। সুভাষ চন্দ্র যখন জাপানে পৌঁছলেন, সেই ফৌজের দায়িত্ব তুলে দিলেন `বেহারী বোস`। যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, যে একদিন ভারতের স্বাধীনতা দেখবেন, সেটা অবশ্য আর পূরণ হয় নি।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগেই যক্ষায় ভুগে তার মৃত্যু হয়। তবে ওই বাঙালি বিপ্লবীর তৈরী মুরগির ঝোল ভাত এখনো জাপানিদের হৃদয়ে গেঁথে আছে – কিছুদিন আগেই যে রেসিপির নব্বই বছর পূর্তি উৎসব পালন করল নাকামুরায়া।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর