দেশত্যাগ ও অভিবাসীদের আশ্রয়

হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনার উদ্দেশে বের হন, তখন তিনি ভেজা চোখে বলেছিলেন, ‘হে মক্কা! যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’

মাটি ও মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। প্রতিটি মানবমনে বিছানো থাকে স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি মায়ার স্তর, ভালোবাসার মায়াবী পর্দা। এ মায়া ও ভালোবাসা স্বভাবজাত। জন্মগত উত্তরাধিকার। শত প্রতিকূলতার মাঝেও মানুষ তার জন্মভূমি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চায়। জীবনে-মরণে ঠাঁই চায় আপন ভূমে। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনার উদ্দেশে বের হন, তখন তিনি ভেজা চোখে বলেছিলেন, ‘হে মক্কা! যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’

তবুও পৃথিবীতে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে হয় অন্যত্র। পৃথিবীর প্রাচীনকাল থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ধর্মীয় মতবাদ, রাজনৈতিক স্বার্থ ও জাতিগত সংঘাতের শিকার হয়ে মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ নবী-রাসুলরাও রেহাই পাননি এ নির্মমতা থেকে। এজন্য সভ্যতার সূচনাকাল থেকে অভিবাসন ও অভিবাসীদের আশ্রয় প্রদানের বিষয়টি একটি বিশ্বজনীন মানবিক আইনে পরিণত হয়েছে। ইসলাম আগমনের আগে বর্বর আরব সমাজেও অভিবাসী ও শরণার্থীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পেত। যুবক বয়সে হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিলফুল ফুজুল নামে যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তার অন্যতম প্রধান ধারা ছিল অভিবাসীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান। একইভাবে ইসলাম আগমনের আগে ‘দ্বীনে হানিফিয়্যাহ’ তথা মানবিক ধর্মে বিশ্বাসী হজরত খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.) এর গুণাবলি উল্লেখ করেছিলেন, সেখানেও অভিবাসীদের আশ্রয় ও সহযোগিতার বিষয়টি ছিল। আধুনিককালেও আন্তর্জাতিক আইনগুলোতে শরণার্থীদের অধিকার স্বীকৃত। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদেও শরণার্থীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার সনদের ১৪নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্যাতন এড়ানোর জন্য প্রত্যেকেরই অন্য দেশগুলোতে আশ্রয় প্রার্থনা এবং আশ্রয় লাভের অধিকার আছে।’ (সূত্র ইন্টারনেট)।
১৯৯০ সালে ওআইসি কর্তৃক কায়রো মানবাধিকার ঘোষণায়ও শরণার্থীর অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। ১২নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘শরিয়তের ভিত্তিতে প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে চলাচল এবং দেশে ও বিদেশে বসবাসের স্থান নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। নির্যাতিত হলে অন্য দেশে আশ্রয় লাভের অধিকার পাবে। আশ্রয়দাতা দেশ তার পূর্ণ নিরাপত্তা দান করবে যতদিন না সে নিরাপদে আপন ভূমিতে ফিরতে পারে এবং যদি না সে শরিয়তবিরোধী কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়।’
পবিত্র কোরআনে নবী-রাসুল (আ.) ও মোমিনদের একাধিক হিজরত তথা দেশত্যাগের ঘটনা বিবৃত হয়েছে। যেমন হজরত ইবরাহিম ও লুত (আ.) এর দেশত্যাগের ব্যাপারে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি তাকে ও লুতকে মুক্তি দিলাম এমন ভূমিতে যা আমি বিশ্ববাসীর জন্য বরকতময় করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ৭১)।
হজরত মুসা (আ.) এর দেশত্যাগের বিবরণও কোরআনে এসেছে। তিনি সময়ের অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে জীবন রক্ষার জন্য দেশত্যাগে বাধ্য হন। এবং মাদায়েনে হজরত শোয়াইব (আ.) এর কাছে আশ্রয় লাভ করেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়Ñ
‘শহরের প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি ছুটে এলো। বলল, হে মুসা! নিশ্চয় শাসকবর্গ তোমাকে হত্যার পরামর্শ করছে। সুতরাং তুমি বের হয়ে যাও। নিশ্চয় আমি তোমার কল্যাণকামী। ফলে তিনি ভীত অবস্থায় বের হলেন পথের অনুসন্ধান করতে। বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে অত্যাচারী জাতির হাত থেকে মুক্তি দিন। যখন তিনি মাদায়েন অভিমুখে রওনা হলেন, বললÑ আশা করা যায় আমার প্রভু আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন। যখন মুসা তার (শোয়াইব আ.) কাছে পৌঁছালেন এবং ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি বললেনÑ ভয় পেও না। তুমি অত্যাচারী জাতি থেকে মুক্তি পেয়েছ। কন্যাদ্বয়ের একজন বলল, তাকে কাজে নিযুক্ত করুন। কেননা শ্রমিক হিসেবে সেই উত্তম যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত। তিনি বললেন, আমি তোমাকে আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আমার কাজ করবে ৮ বছর। যদি তুমি ১০ বছর পূর্ণ করো তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চান তো তুমি আমাকে সৎকর্মশীল পাবে।’ (সুরা কাসাস : ২০-২৭)।
এ ঘটনায় ইসলামের শরণার্থী নীতি প্রস্ফুটিত হয়। হজরত শোয়াইব (আ.) হজরত মুসা (আ.) কে শুধু আশ্রয়ই প্রদান করেননি; বরং তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন এবং কন্যাদানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। একই সঙ্গে দেশত্যাগে বাধ্যকারী শাসক ফেরাউন ও তার জাতিকে কোরআনে ‘অত্যাচারী’ বলা হয়েছে।
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পরও হজরত রাসুলে আকরাম (সা.) সাহাবায়ে কেরামের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি মুহাজির (দেশত্যাগকারী) ও আনসার (আশ্রয়দাতা ও সাহায্যকারী) সাহাবিদের মধ্যে ‘ভ্রাতৃত্ববন্ধন’ স্থাপন করেন। এটি ছিল একটি সাময়িক ব্যবস্থা। কিন্তু ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ‘ভ্রাতৃত্ববন্ধন’ এর ফলে আনসার ও মুহাজিররা আত্মার আত্মীয়তে পরিণত হন। বদরযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ সাহাবিরা রক্তের আত্মীয়ের মতো পরস্পর সম্পদের অধিকারী হতেন। পরে মুহাজিরদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি হলে এ ব্যবস্থা রহিত হয়। কিন্তু হৃদয়ের বন্ধন অটুট থাকে। (মাওলানা সফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-৩১৭)।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে তাদের ত্যাগ ও ভালোবাসার প্রশংসা করে বলেন, ‘যারা তাদের (মুহাজিরদের) আগে এ জনপদকে নিজেদের নিবাস করেছিল এবং যারা (তাদের আগমনের) আগে ঈমান এনেছিল, তারা অত্যন্ত ভালোবাসে তাদের যারা হিজরত করেছে। মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনো চাহিদা অনুভব করে না। তারা সর্বদা অগ্রাধিকার দেয় তাদের (মুহাজিরদের); যদিও তারা অভাবগ্রস্ত। প্রকৃতপক্ষে যাদের অন্তরের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম।’ (সূরা হাশর : ০৯)।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর