রোহিঙ্গা সঙ্কট : কার লাভ, কার ক্ষতি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এবারও যদি বাংলাদেশ সকল রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয় তাহলে রোহিঙ্গামুক্ত হবে মিয়ানমার, বাস্তবায়িত হবে তাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের উপর কার্যকর কোনো চাপ প্রয়োগ না করে স্রেফ বাংলাদেশকে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানানোর সুফল মিয়ানমার সরকারের পক্ষেই যায়। মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘদিনের দাবি হচ্ছে- রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী; মিয়ানমারের নাগরিক নয়।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতা ও উদারতার জন্য বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা, সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছে এদেশের সরকার ও জনগণ। রোহিঙ্গাদের দুই হাজার একর জায়গায় প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনও চলছে। ব্যাক্তিগতভাবে ত্রাণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কেউ কেউ আড়ালে ত্রাণ দিচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা ও প্রশাসনও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সুশৃঙ্খভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে। তবুও ত্রাণের অধিকাংশই আগে থেকে এখানে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা ভোগ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ত্রাণের জন্য যানবাহনের পেছনে ছুটতে গিয়ে বেশকিছু রোহিঙ্গা শিশু, কিশোর ও নারীর আহত হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে।

কিন্তু এই সঙ্কটকে পুঁজি করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দু’পাড়ের কিছু কিছু সুবিধাভোগী সুযোগ নিচ্ছে।  সুবিধাভোগীরা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন মালামাল, পকেটের টাকা, নারীদের স্বর্ণালংকার, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, কম্বল, হাড়ি-পাতিল তথা শেষ সম্বল ও সর্বস্ব লুটপাট করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় কতিপয় সুবিধাভোগী পানির দরে কিনেও নিচ্ছে। টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে দালালরা। শরণার্থী রোহিঙ্গারাই টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্যা পাহাড় কেটে সমান করে অস্থায়ী ঘর বেঁধে আশ্রয় নিচ্ছে। পাহাড় ও বন উজাড় হওয়ার ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। শরণার্থীদের চাপে বেড়ে গেছে  চাল, ডাল, আলু, তেলসহ প্রয়োজনীয় সকল নিত্য পণ্যের দাম। এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী বিক্রেতা রোহিঙ্গা সঙ্কটকে পুঁজি করে দিগুন দামে এসব পণ্য বিক্রি করছে। বাড়ির মালিকদের বাধা সত্ত্বেও অনেক রোহিঙ্গা কান্নাকাটি করে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন বাড়ির সীমানায় আশ্রয় নিচ্ছে, তাড়িয়ে দিলেও আবার বাড়ির সীমানায় এসে অস্থায়ী ঘর বাঁধছে।

বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়া যেন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, রীতিমতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই এলাকায় মাদক চোরাচালান চক্র অত্যন্ত সক্রিয় এবং সীমানার উভয় দিকে তাদের প্রভাব বিস্তৃত। অবৈধ অস্ত্রের বেচা-কেনাও হয়।  সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সংগ্রহ, গভীর বনে প্রশিক্ষণের সুবিধা ও লুকিয়ে থাকার স্বর্গ হিসেবে এলাকাটি ব্যবহূত হলে তা হবে অশনি সংকেত। অর্থনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা ও রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এক শ্রেণীর সুবিধাভোগীরা শরণার্থীদের দুর্ভোগ কাজে লাগিয়ে কোটিপতি বনে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজেদের পরিচয় গোপন করে এদেশের পাসপোর্টও করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনায় রোহিঙ্গারাও জড়িত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। ভুলে গেলে চলবে না সব রোহিঙ্গারাই ভালো মানুষ হবেন এমনটি নাও হতে পারে। অর্থের লোভ ও খিলাফতের স্বপ্ন দেখিয়ে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকরা এদেরকে যাতে দলে ভেড়াতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সতর্কও থাকতে হবে।

গত ক’বছর ধরে বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন ঘটনার লোমহর্ষক ছবিকে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো নির্যাতন বলে এক ধরনের প্রচারণা চলছে অনলাইন-জুড়ে। এতে করে প্রকৃত সত্য আড়ালে পড়ে যাচ্ছে মিথ্যা প্রচারণায়, প্রকৃত নির্যাতনের কাহিনী হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। একটা মিথ্যা অন্য অনেক সত্যকে আড়াল করে দিচ্ছে সহজেই। এতে কার লাভ হচ্ছে? ইসলামপন্থী অনেক রাজনৈতিক দল একে ধর্মের আবরণ পরিয়ে দিচ্ছে। এতে করে বিশ্ব সমাজ একে ধর্মীয় সংঘাত বলে ভাবতে পারে, যাতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানো রাজনৈতিক দলগুলো এই সঙ্কট থেকে ফায়দা লুটতে চেয়ে দেশের সমস্যাকে জটিলতার আবর্তে আবদ্ধ করে ফেলতে পারে। একে একে সকল রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত হয়ে গেলে মিয়ানমারের উদ্দেশ্যপূরণ হবে, নির্যাতনের মাধ্যমে একটি নৃগোষ্ঠীকে দেশছাড়া করারও নজির স্থাপন হয়ে যাবে। যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে তারা কোনোভাবেই আর তাদের দেশে ফেরত যেতে রাজি হবে না। এভাবে মিয়ানমার সরকার চাওয়াটাই পূরণ হবে!

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দেয়া ‘টেম্পোরারি সলিউশন’, ‘পার্মানেন্ট সলিউশন’ নয়। সারা বিশ্বকে বুঝাতে হবে রোহিঙ্গা ইস্যু ধর্মীয় কোনো বিষয় নয়, এটা জাতিগত সংঘাত। রোহিঙ্গা নির্যাতনকে শুধুমাত্র ধর্মীয় বিদ্বেষ বলে প্রচারণা চালালে রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারই করা হবে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন সিরিয়া-ইরাকের শরণার্থীদের যদি ইউরোপের সব দেশ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে আশ্রয় দিতে পারে, এমনকি তারা কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রেও যেতে পারেন, তাহলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও তা করতে অসুবিধা কোথায়? মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ পরিচয় দিয়ে বিশ্বে নতুন করে ব্রান্ডিং করার সুযোগ দেয়া উচিৎ নয়। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলাও ঠিক নয়। রোহিঙ্গা সঙ্কটকে বাংলাদেশের আপদ হিসেবেই দেখা উচিৎ। সতর্ক থাকতে হবে যাতে ত্রিদেশীয় সংযোগ ও পার্বত্যভূমির দুর্গমতা সংগঠিত অপরাধী চক্রের অভয়ারণ্যে পরিণত না হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী, জঙ্গি ও অপরাধী চক্রের আঁতাত জননিরাপত্তার উপর ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে  না আনে।  অস্ত্র- মাদক চোরাচালান ও  মানব পাচার জননিরাপত্তাকে ভঙ্গুর করে না তুলে।

মনে রাখতে হবে- নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশী-বিদেশী অশুভ শক্তি অনেক ফাঁদ পেতেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামিকে উপজীব্য করে রোহিঙ্গাদের হিংসার পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে, মানব পাচারের ক্ষেত্র বানিয়েছে, মাদক পাচারের বাহক করেছে এবং বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভাঙতে ব্যবহার করেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে কখনো তারা বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকির উত্স হতে না পারে। নতুবা এদেশের মানুষরাও সেসব অঞ্চলে সংখ্যালঘু হয়ে যেতে পারে। তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া কতদিন সাহায্য করবে তার নিশ্চয়তা নেই। মালয়েশিয়া এগিয়ে আসবে না কিছু রিফিউজি নিতে হতে পারে এমন ভয়ে!  থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন মিয়ানমারের বিপক্ষে  যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। চীন ও ভারত থাকবে মিয়ানমারের পাশেই। ফলে কিছু এনজিও ও গ্রুপকে টাকা দিয়ে যারা ত্রাণ সরবরাহ করবেন তারাও যে দীর্ঘমেয়াদে তা’ করবেন এমনটা নাও হতে পারে। অবশ্যই নির্যাতিত মজলুম মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো ভালো কাজ। তবে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সেন্টমার্টিনে ঘাঁটি গাড়ার কারো খায়েশ যাতে পূরণ না হয়; সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে এখন থেকেই। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে যারা হত্যা করেছে, এ সঙ্কট সমাধানে তারা কতটুকু  ভুমিকা রাখতে পারবে তা’ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ আছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর