নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির যত ভাবনা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আগামী সংসদ নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে হলে ভালো হয়-এ নিয়ে বিএনপি তাদের প্রত্যাশিত কাঠামো ঠিক করছে। এ জন্য তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পরামর্শও চেয়ে আনা হয়েছে।

কেন্দ্রের বাইরে থেকে আসা মতামত বিশ্লেষণ করছে এমন সূত্রের মতে, তৃণমূল নেতারা আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের পক্ষেই মত দিচ্ছেন। তবে তাদের অনেকে এও মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তার ফল ভালো নাও হতে পারে।

এখন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা ও বিএনপি সমর্থক বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এ নিয়ে কাজ করছেন। তারা খসড়া জমা দিলে তার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা তৈরি করে আগামী নভেম্বরের শেষ দিকে তুলে ধরতে পারেন খালেদা জিয়া।

জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি আমাদের পুরোদমে চলছে। আমাদের মহাসচিব তৃণমূলকে চিঠি দিয়ে তাদের পরামর্শ নিয়েছেন। এর প্রতিফলন সহায়ক সরকারের পদ্ধতি, যেটি আমাদের দলীয় প্রধান তুলে ধরবেন, সেখানে অবশ্যই থাকবে।

তিনি বলেন, ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন আর এ দেশে হবে না। শিগগিরই আমাদের দলীয় প্রধান সবার সঙ্গে পরামর্শ শেষে একটি পদ্ধতি জাতির সামনে তুলে ধরবেন।

সেই আলোকে একটি নিরপেক্ষ পদ্ধতি বের করতে এ সরকারকে বাধ্য করা হবে। সেটি ‘সহায়ক সরকার’ বা ‘নির্দলীয় সরকার’ অথবা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ যে নামেই হোক না কেন।

এই নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর কাছেও লিখিত সুপারিশ চেয়েছিল বিএনপি। এরই মধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক দল সে সরকারের পদ্ধতি কেমন হতে পারে, তা লিখিত আকারে বিএনপির মহাসচিবের কাছে জমা দিয়েছে।

কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান বলেন, গত ১৫ তারিখে আমরা আমাদের লিখিত বক্তব্য বিএনপির মহাসচিবের কাছে জমা দিয়েছি। বেশ কিছু প্রস্তাব আমরা রেখেছি। এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে ছুটিতে পাঠিয়ে একটি সরকার গঠন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি সরকার গঠন অথবা সমাজের নিরপেক্ষ বিশিষ্টজনদের নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা।

জোটের আরেকটি শরিক দলের নেতা জানান, তারাও গত সপ্তাহে তাঁদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

তিনি জানান, তারা যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেখানে কয়েকটি শর্ত দিয়ে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। শর্তের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা, বিশেষ করে তিনি কোনো নির্বাহী আদেশ দিতে পারবেন না। আবার দায়িত্বে থেকেও তিনি ছুটিতে যেতে পারেন। তারা প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ চার মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তাব করেছেন।

বিএনপির নয়াপল্টন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত জুনে দলের জেলা ও মহানগর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল।

দলের মহাসচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী হলে দলের জন্য ভালো হয়, দলের সাংগঠনিক কাঠামো কিভাবে সুদৃঢ় হয়-এসব জানতে চাওয়া হয়। চিঠিতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় কারাবন্দি কিংবা মামলার কারণে এলাকা ছাড়া এমন নেতাকর্মীদের নাম যুক্ত করাসহ অন্যান্য দিকনির্দেশনা ছিল।

জুনেই তৃণমূলে পাঠানো আরেক চিঠিতে নির্বাচনী আসনের সীমানাসংক্রান্ত সমস্যাবিষয়ক প্রতিবেদন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এক মাস সময় দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে সমস্যাগুলো লিখিতভাবে কেন্দ্রকে জানাতে হবে।

দলটির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু জানান, এরই মধ্যে সব কটি চিঠি কেন্দ্রে এসে পৌঁছেছে। তা দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে পাঠানোও হয়েছে। তারা এখন বিশ্লেষণ করবেন।

জানা গেছে, তেমন ‘হাই প্রফাইল নন’ এমন নেতা ও দেশের খ্যাতনামা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি সমর্থক শিক্ষকদেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা মাঠে নিজস্ব লোকবল দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজটি এগিয়ে নিচ্ছেন।

এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন এমন একজন নেতা জানান, হাই প্রফাইল নেতাদের এ কাজের দায়িত্ব না দেওয়ার কারণ হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের মতামত নির্ভুলভাবে তুলে আনা সহজ করা। কারণ বড় নেতা হলে তাদের পছন্দের লোকের পক্ষেই সাফাই গাইতে হবে না হলে পরবর্তী সময়ে বিরাগভাজন হওয়ার ভয় থাকে। ফলে অনেকেই সঠিক তথ্যটি বলতে চায় না।

এদিকে কোন আসনে কোন প্রার্থী কতটা জনপ্রিয় তারও একটি তালিকা তৈরি করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এটা অনেকটা অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে। দলটি মনে করছে, ২০০ আসনে তাদের প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত। বাকি ১০০ আসনে নতুন প্রার্থী বা জোটের শরিকদের থেকে আসবে। এ নিয়ে কাজ করছে বিএনপির এমন এক নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করার বিষয়ে তৃণমূলের মতামত তুলে আনাই তাদের মূল লক্ষ্য। তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপির সম্ভব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার বিষয়টিরও তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, বিগত সময়ে তৃণমূলের সুপারিশগুলো সেভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। সুপারিশের ভিত্তিতে দল পুনর্গঠনসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড চললে সাংগঠনিক ভিত এত দুর্বল হতো না। দুই দফা আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়াসহ জাতীয় ইস্যুগুলোতে বিএনপি এতটা পিছিয়ে পড়ত না।

সূত্র মতে, তৃণমূলের সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গণতন্ত্রের চর্চা ও দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব স্বচ্ছ রাখা পরিবারতন্ত্র থেকে সরে এসে নেতৃত্বে সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা। দুর্নীতির ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে এমন নেতাকে মূল নেতৃত্বে না রাখার সুপারিশে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দ্বন্দ্ব নিরসনে সব পর্যায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দল গঠনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল।

শুধু তাই নয়, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে এবং ওয়ান-ইলেভেনে যারা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের দলীয় কোনো পদে না রাখতে তৃণমূলের পাঠানো সুপারিশ রয়েছে।

জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, তৃণমূলের সুপারিশ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এগুলো এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। সুপারিশমালার খসড়া চূড়ান্ত করে দলের হাইকমান্ডের কাছে দেওয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, এবার দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন, উপজেলা, পৌর নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্বকে। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা নেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। এর ফলও আমরা পেয়েছি। সরকারের ভোট জালিয়াতির কারনে আমরা অনেক স্থানে জয়ী হতে পারিণি। কিন্তু তৃণমূলের প্রার্থী বাছাই যে অনেকাংশে সঠিক ছিল, তা পরিষ্কার।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তখনকার মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি। একজন সম্মানিত নাগরিকের নেতৃত্বে সাবেক ১০ উপদেষ্টাকে নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের পাল্টা প্রস্তাব দেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।

জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধির দূতিয়ালিতেও সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমঝোতা হয়নি। জাতীয় পার্টি ও পুরনো শরিকদের কয়েকজনকে মন্ত্রিসভায় এনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেন। সেই সরকারের অধীনেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোট হয়। বিএনপি ও শরিকদের বর্জনের মধ্যে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর