নৃশংস সেই হত্যাকাণ্ডের পর

ভোরের দিকে কয়েকটি রাশান মিগ-২১ বিমান ঢাকার আকাশ কাঁপিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে উড়ে যায়। সঙ্গে হেলিকপ্টার। শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমরা চমকে উঠি। অনেক দিন পর ঢাকার আকাশে এ কিসের গর্জন? কার গর্জন? বঙ্গবন্ধুর নয়তো!

মারাত্মক একটা কিছু ঘটেছে_ এমন আশঙ্কায় দ্রুত রেডিও নিয়ে আমরা সংবাদ শুনতে বসি। কিন্তু না, রেডিও চলছে না। একেবারে বন্ধ। কোনো সাড়া-শব্দই নেই। তবে? ভালো করে সকাল হবার আগেই পাড়ার মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়…
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, আমার মধ্যে যে তীব্র ভীতি, প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ ও উৎকণ্ঠা মিশ্রিত আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল; তার অন্তরালের মনস্তাত্তি্বক পটভূমি উপরে কিছুটা বর্ণিত হলো। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে মনে পড়ে যায় আমার বড় ভাইয়ের কথা। আমি ভাবতে বসি, তবে কি আবার আমাকে ভারতে চলে যেতে হবে? দেশটা কি আবার পাকিস্তানে পরিণত হবে? ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ভিতরে ফুটে ওঠা অভাবিত নির্মমতার দিকটির কথা ভেবে আমি খুবই বিচলিত ও অসহায় বোধ করি। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, হত্যাকারীদের মনে ঘৃণার এই যে জোর_ তারা কোথা থেকে তা পেল? প্রতিহিংসাপরায়ণতার এই যে উচ্চ মাত্রা_ তা কি কেবলই মুহূর্তের মতিভ্রম? আমার বিশ্বাস হয় না। বিপুলসংখ্যক মুসলমানের বাসভূমি হলেও, এক শ্রেণীর মুসলমানের কাছে চিরশত্রুরূপে গণ্য হিন্দুস্তানের সহায়তায় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানকে ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠন করার অপরাধই ঐরূপ দুর্মর ঘৃণার জাতক ছিল বলে আমার মনে হয়।
মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থায় আমি ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম, গ্রামের নির্জনতা ও রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে পাবার আশায়। কাদের বাহিনীর থানা আক্রমণ ও আক্রমণের সঙ্গে আমার মামার জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ শুনে আমি কিছুটা উন্মাদের মতোই আমার পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে দিনাতিপাত করতে থাকি। ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে আমার তরুণ কবি বন্ধু গোলাম সাবদার সিদ্দিকী হঠাৎ একদিন আমার গ্রামে হাজির। ওর আগমনে আমার মানসিক শান্তি বিঘি্নত হয়। ওর অতিবিপ্লবী নকশাল মার্কা কথাবার্তা আমার খুবই অপছন্দ ছিল। ফলে তাকে আমি বেশিদিন আমার বাড়িতে থাকতে দিই না।
অক্টোবরের মাঝামাঝি, হঠাৎ একদিন ঢাকা থেকে একই খামে পাঠানো আমার দুই কবি বন্ধু আবুল হাসান ও মহাদেব সাহার দুটি চমৎকার চিঠি পাই। তাদের সমবেদনাসিক্ত চিঠি দুটি পড়ে, বিশেষ করে আবুল হাসানের চিঠিটি পড়ে আমি ঢাকার প্রতি আমার অভিমান অনেকটাই ভুলে যেতে সক্ষম হই। আবার ঢাকা আমাকে ডাকে_ আয় ফিরে আয়। তখনও আমি শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ ছিলাম না। তাই আমার বাবা-মা আমাকে ঢাকায় যেতে বারণ করেন। আমার মা-বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমি নভেম্বরের শুরুতে ঢাকায় ফিরে আসি।
একাত্তরের ৯ মাস বাদ দিলে, এর আগে এত দীর্ঘদিন আমি আমার প্রিয় নগরী ছেড়ে বাইরে কখনও থাকিনি। প্রায় আড়াই মাস পর, বঙ্গবন্ধুহীন এই নগরীতে ফিরে এসে আমি আর আমার নিউপল্টনের বাঁশের বেড়ার মেসটিতে ফিরে যাইনি। আমি আমার বন্ধু মহাদেব সাহার ১১২, আজিমপুরের বাসায় উঠি। দীর্ঘ দিন পর আমাদের দেখা হয়। আমরা দু’জন মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি। আমরা হিসাব মিলাতে চাই। কেন এই হত্যাকাণ্ড? কেন এই নৃশংসতা? এখন কোথায় যাবে বাংলাদেশ? সংখ্যালঘুরা বঙ্গবন্ধুহীন এই নতুন বাংলাদেশে থাকতে পারবে কি? ধর্মনিরপেক্ষতার পথ কি অনুসৃত হবে আর? নাকি একটি মিনি পাকিস্তানে (‘মুসলিম বাংলা’ কথাটা তখন চালু হয়েছিল) পরিণত হবে এ দেশ? আলাপে-উদ্বেগে রাত ভোর হয়ে আসে। বাইরে খুব কমই বেরোই আমরা। মহাদেবের বাসায় অনেকটাই গৃহবন্দির মতো আমি থাকি। আমি যে ঢাকায় ফিরে এসেছি, তা খুব একটা মানুষকে জানাতে চাই না। পরদিন আবুল হাসানের সন্ধানে ওর শান্তিনগরের বাসায় যাব, ওইরূপ স্থির করে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে আমরা ঘুমিয়েছিলাম।
ভোরের দিকে কয়েকটি রাশান মিগ-২১ বিমান ঢাকার আকাশ কাঁপিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে উড়ে যায়। সঙ্গে হেলিকপ্টার। শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমরা চমকে উঠি। অনেক দিন পর ঢাকার আকাশে এ কিসের গর্জন? কার গর্জন? বঙ্গবন্ধুর নয়তো!
মারাত্মক একটা কিছু ঘটেছে_ এমন আশঙ্কায় দ্রুত রেডিও নিয়ে আমরা সংবাদ শুনতে বসি। কিন্তু না, রেডিও চলছে না। একেবারে বন্ধ। কোনো সাড়া-শব্দই নেই। তবে? ভালো করে সকাল হবার আগেই পাড়ার মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়। সবারই প্রশ্ন_ রেডিও বাংলাদেশ বন্ধ কেন?
আকাশবাণী বা বিবিসিও আমাদের কোনো খবর দিতে পারে না। আমরা খবর জানতে দুপুরের দিকে প্রেস ক্লাবে যাই। ওখানে গিয়ে খবর পাই, ভোরের দিকে সামরিক বাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এ অভ্যুত্থানটি করেছেন। সকালের দিকে ঢাকার আকাশে যে বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো উড়েছিল সেগুলো উড়েছিল ওই অভ্যুত্থানেরই পক্ষে। বিমান ও হেলিকপ্টারগুলোকে নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বঙ্গভবনের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখা গেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তখন ১৫ আগস্টের মোশতাকবর্ণিত সূর্য-সন্তানদের ট্যাংক ও আর্টিলারি বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। ফলে অভ্যুত্থানটি যে ওইসব তথাকথিত সূর্য সন্তানের বিরুদ্ধেই ঘটেছে, তা বেশ সহজেই বোঝা গেল।
আমরা সতর্কতার সঙ্গে আমাদের মনের খুশি-ভাবটাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আমরা হচ্ছি ঘরপোড়া গরু। আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই। বলা তো যায় না, যদি অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয়ে যায়! আমি আর মহাদেব দ্রুত বাসায় ফিরে আসি এবং আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ শোনার জন্য রেডিও নিয়ে বসি। ঢাকা বেতার তখনও বন্ধ, তবে টিভি চালু ছিল। টিভিতে এমন কিছু সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল না, যা থেকে সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো সঠিক ধারণা লাভ করা যায়। বিবিসির রাতের খবরে আমরা জানতে পারি যে, ৩ নভেম্বর ভোরের দিকে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার জাতীয় নেতা_ সৈদয় নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান নিহত হয়েছেন। শুনে বেদনা ও ঘৃণায় আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। আমাদের চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যায়। আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই। এও কি সম্ভব? এ রকম একটি বর্বর হত্যাকাণ্ডের কথা তো আমরা ভাবতেও পারি না। পরে ১৫ আগস্টের নৃশংসতার দিকটির কথা স্মরণ করে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসি, অতঃপর ওই রকমের কাজ এ দেশের মাটিতে খুবই সম্ভব।
পরদিন আমরা দু’জন ভয়ে ভয়ে বাসা থেকে বেরোই। আমরা যাব নিউমার্কেট হয়ে প্রেস ক্লাবে। মহাদেবকে তাঁর ছেলের জন্য দুধ সংগ্রহ করতে হবে। তখন গুঁড়া দুধের খুবই আকাল চলছিল। নীলক্ষেতের কাছে যেতেই দেখি একটি মিছিল আসছে। মিছিল? আমরা চমকে উঠি। ১৫ আগস্টের পর এটিই ঢাকার প্রথম মিছিল। নীরব মিছিলটি যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। মিছিলে লোকজন খুব বেশি একটা নেই। শ’দুয়েক হবে। ওই মিছিলে আমাদের পরিচিত অনেকেই। আমাদের পরিচিত বন্ধুদের মিছিলে দেখে আমরাও ওই মিছিলে ভিড়ে যাই। শুনতে পাই এ মিছিলের অগ্রভাগে আছেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধ মাতা এবং ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ। শুনে খুব ভালো লাগে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার জাতীয় নেতার হত্যা, না ১৫ আগস্টের মোশতাকবর্ণিত সূর্য সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান_ কোনটি আগে ঘটছে, তা কেউই সঠিক করে বলতে পারল না। জানলাম, এটি একটি মস্ত বড় ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ মিছিলের আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি দিবস পালনের জন্য ঐ মিছিলের আয়োজন করেছিল। ঐ মিছিলে ছিলেন সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমদ, সংসদ সদস্য শামসুদ্দিন মোল্লা, সংসদ সদস্য রাশেদ মোশাররফ, খন্দকার মুহম্মদ ইলিয়াস (মরহুম), জনাব মোস্তফা মহসীন মন্টু, বেগম মতিয়া চৌধুরী, জনাব সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জনাব ইসমত কাদির গামা, খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধ মাতা প্রমুখ।
৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানটি না ঘটলে, মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া কি সম্ভব হতো? মনে হয় না। দীর্ঘ বিরতির পর বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ লাভ করার জন্য আমরা খুবই খুশি হই এবং খালেদ মোশাররফের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করি।
সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়ার খবর কী_ তা তখনও জানতে পারি না। তিনি কোথায় আছেন, তিনি কী ভাবছেন_ তা কেউই বলতে পারে না। খালেদ কি তাঁর বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান করেছেন? নাকি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে? জিয়া কি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পক্ষে আছেন_ না বুঝতে পারার প্রচণ্ড উত্তেজনা বুকে নিয়ে আমি অপেক্ষা করতে থাকি রাতে বিবিসির সংবাদভাষ্য শোনার জন্য। তখনও আমি ভাবতে ভালোবাসি, যার কণ্ঠে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের দুপুরে আমি বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ইথারে তরঙ্গিত হতে শুনেছিলাম_, মুক্তিযুদ্ধের সেই বীর, সেই মুজিবভক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানও এই অভ্যুত্থানে নিশ্চয়ই খালেদের পক্ষেই আছেন। হয়তো খালেদকে সামনে দিয়ে তিনি পেছনে অবস্থান গ্রহণ করেছেন কোনো কৌশলগত কারণে।
আমেরিকার নির্বাচন শেষ হয়েছে। আজ সকাল সকাল (৬ নভেম্বর) বাংলাবাজার পত্রিকা অফিসে আসার আগে পুনর্নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের বিজয় ভাষণ সিএনএন-এর চ্যানেলে শুনে এসেছি।
২ নভেম্বর তারিখে বাংলাবাজারের উপসম্পাদকীয় পাতায় ১৯৭৫ সালের রক্তঝরা নভেম্বরের স্মৃতিচারণমূলক যে লেখাটি শুরু করেছিলাম, আজ তার পরবর্তী কিস্তি লেখার কথা। প্রশ্ন উঠতে পারে, আজকের লেখার সঙ্গে আমেরিকার নির্বাচনের কোনো প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক আছে কি? হ্যাঁ, আছে। খুবই সম্পর্ক আছে। ১৯৭৫ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল রিপাবলিকান দলের হাতে। আমেরিকার রিপাবলিকানরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আমাদের পক্ষে ছিল ভারত-রাশিয়াসহ পূর্ব-ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবির। আমেরিকান সশস্ত্র বিরোধিতার পরও আমরা যখন আমাদের বহু প্রত্যাশিত স্বাধীনতা লাভ করি, তখন আমেরিকা তা ভালোভাবে নিতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের পরাভববোধ কাজ করছিল। তদুপরি বঙ্গবন্ধু যখন দেশ চালাতে গিয়ে রাশিয়া-কিউবা (আমেরিকার নিষেধ সত্ত্বেও কিউবায় চটের থলে রফতানি করা) ঘেঁষা নীতি গ্রহণ করেন, তখন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে উৎখাত করে বাংলাদেশকে একটি মিনি-পাকিস্তানে পরিণত করার ব্যাপারে আমেরিকার কম করেও নীরব সমর্থন তো ছিলই। এমন কথাই তখন আমরা শুনেছিলাম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর