ভয়াবহ পুষ্টি সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে মানবজাতি

পৃথিবী গতিশীল। প্রতিনিয়ত পৃথিবী তার রূপ পাল্টাচ্ছে। আদিম যুগ পাড়ি দিয়ে পৃথিবী এখন রয়েছে আধুনিক যুগে। অর্থাৎ সভ্যতার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধন হয়েছে এই যুগে। যার ছোঁয়া লেগেছে সবকিছুতে। আধুনিক যুগের মানুষ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের পাশপাশি খাদ্যবস্তুর উৎপাদনেও অনেক পরিবর্তন এনেছে। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদনেও আধুনিকতার ছোঁয়া পুরোপুরি লেগেছে।

আধুনিক কলা-কৌশল ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে মানুষ নানা যন্ত্রপাতি ও ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার করছে। ক্ষতিকর এ সব পদার্থের কারণে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গ। ‍আধুনিক মানুষ ক্ষুদ্র এ সব সৃষ্টিকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না। কিন্তু এর ফল যে কত ভয়াবহ তা চিন্তা করলে শিউরে উঠতে হয়। মানুষ মনে করছে, এর মাধ্যমে তারা নিরাপদ, পরিমাণে বেশি কিংবা উন্নত মানের শস্য উৎপাদন করছে। কিন্তু বিষয়টা তা নয়, বরং এর মাধ্যমে মানুষ যেন তার মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে আসছে।

গবেষকরা বলেছেন, সব ধরনের পাখি, ক্ষুদ্র পতঙ্গ, মৌমাছি এবং অন্যান্য সৃষ্টি (ক্রিয়েচার), অর্থাৎ যারা খাদ্য-শস্যে পরাগায়ন ঘটায়, তারা যদি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় তাহলে মানবজাতি চরম পুষ্টিহীনতার সম্মুখীন হবে। এর ফলে রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়বে এবং বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষ মারা যাবে।

বিশ্বের ১৫৬টি দেশের ২২৪ ধরনের খাদ্য-শস্য নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা দেখেছেন যে, এ সব খাদ্যে যে ভিটামিন ও পুষ্টি রয়েছে তা নির্ভর করে বিভিন্ন প্রাণীর পরাগায়নের ওপর। পাশাপাশি এ সব প্রাণী যদি দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পরাগায়ন না ঘটে তাহলে মানবজাতি ব্যাপক পুষ্টি ঘাটতির সম্মুখীন হবে।

গবেষকরা অনুমান করছেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে পরাগায়করা (উল্লিখিত প্রাণী) অধিক পরিমাণে মারা যাচ্ছে। ফলে পুষ্টিহীনতা সংক্রান্ত সমস্যাও বেড়ে গেছে এবং এর কারণে বিশ্বে মৃত্যুর হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে গেছে।

আমেরিকার হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভায়রনমেন্টাল হেলথ রিসার্চের (পরিবেশ-স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষক) এবং আলোচিত গবেষণার সিনিয়র গবেষক স্যামুয়েল মেয়ার্স বলেন, ‘উপরোক্ত মৃত্যুর হার থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী মানব স্বাস্থ্যের জন্য পরাগায়ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’

দ্য ল্যানসেট সাময়িকিতে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে মেয়ার্স ও তার সহকর্মীরা লিখেছেন, যদিও বিজ্ঞানীরা বলতে পারছে না যে, বিশ্বের পরাগায়করা কবে বিলুপ্ত হবে, তবে পৃথিবী থেকে যে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য পরাগায়ক বিলুপ্ত হয়েছে বা হ্রাস পেয়েছে সে ব্যাপারে ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২০০৬ সাল থেকে আমেরিকায় মৌচাকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ইউরোপিয়ান কলোনিগুলোতে ১৫ শতাংশ প্রাণী মারা গেছে। এ ছাড়া বিগত ৩০ বছরে উত্তর আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপে বন্য পরাগায়কের সংখ্যা ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। এমনকি বেশ কিছু প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সব পরাগায়ক হ্রাস পাওয়া কিংবা নিশ্চিহ্নের সঠিক কারণ বলা কঠিন। তবে বিজ্ঞানীদের অধিকাংশের মত, কীটপতঙ্গের মধ্যে সংক্রমণ, রোগ-বালাই, কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং কীটপতঙ্গের আবাস (যেমন-জঙ্গল, গাছ-গাছালি ইত্যাদি) ধ্বংস হওয়ার কারণেই এসব প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের স্বাস্থ্য বিভাগকে মেয়ার্স বলেন, কীটপতঙ্গ ও পশু-পাখি হারিয়ে যাওয়া কমানো যেত এমনকি বন্ধ হতো যদি মানুষের জীবনাচরণে পরিবর্তন আনা (যেমন-কীটনাশকের ব্যবহার কমানো) যেত।

গবেষকরা বলছেন, সব ধরনের পরাগায়ক যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৭ কোটির বেশি অল্প উপার্জনের লোক ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতিতে পড়বে। তাছাড়া বিশ্বের যে ২শ’ কোটির বেশি লোক ইতোমধ্যে ভিটামিন ‘এ’র সঙ্কটে ভুগছে (প্রয়োজনের তুলনায় কম পাচ্ছে) তারা আরো সঙ্কটে পড়বে। অথচ পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি, রোগ প্রতিরোধ ও কোষ বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন ‘এ’ অপরিহার্য।

এছাড়া বিশ্বের ১৭ কোটির বেশি লোক ফলিক এ্যাসিডের ঘাটতির সম্মুখীন হবে। আর ঘাটতিতে থাকা ১শ’ কোটি লোক আরো সঙ্কটে পড়বে। ফলিক এ্যাসিড ভিটামিন ‘বি’ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত, যা কোষ বৃদ্ধি, হজম এবং সন্তান জন্মদানের ঝুঁকি প্রতিরোধে সহায়তা করে।

তাছাড়া সব কীটপতঙ্গ তথা পরাগায়ক বিলুপ্ত হলে বিশ্বে ফলের সরবরাহ ২৩ শতাংশ, সবজির ১৬ শতাংশ এবং বাদাম ও বীজের সরবরাহ ২২ শতাংশ কমে যাবে।

গবেষকরা ধারণা করছেন, উপরোক্ত কারণে বাজারে খাদ্যের দাম বেড়ে যাবে। বাজারে খাদ্য বা ফলের যে সরবরাহ হবে তা সম্পদশালীরা ভোগ করার সুযোগ পাবে। এতে গরিব শ্রেণীর লোকেরা তুলনামূলক কম পুষ্টিকর খাবার পাবে।

দ্য বিল এ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং দ্য উইনসলো ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাসের অপরিপূর্ণ কিংবা ক্রটিপূর্ণ তথ্য, বিশেষ করে, সরকারগুলোর পক্ষ থেকে গড় খাদ্য গ্রহণের যে তথ্য রেকর্ড করা হয় তাও উল্লিখিত ঘটনার জন্য দায়ী। কারণ এতে সরবরাহকৃত খাদ্যে পরাগায়কের প্রভাব এবং পুষ্টির উপস্থিতি পরিমাপ করা যায় না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর