গ্রামের মেয়েরা খবরের শিরোনাম হয় নাঃকেফায়েত শাকিল

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিছুদিন আগে বাসে এক আন্টির সঙ্গে পরিচয় হয়। বাসে নিজের আসন ছেড়ে বসতে দেয়ার পর থেকে নানা বিষয়ে কথা হয় দীর্ঘ সময়। গ্রাম থেকে আসা এই মহিলা খুব অল্প সময়ে আপন করে নেন আমাকে। তার আচরণে আমিও আপন ভাবতে বাধ্য হই। তারপর তিনি সঙ্গে থাকা দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে বিথিকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। দশম শ্রেণিতে পড়লেও দেখতে অনেক অল্প বয়সী মনে হয় বিথি নামের ওই মেয়েটিকে। আমি কল্পনাও করিনি সে এত উপরের ক্লাসে পড়ে। বেশি সুন্দরী না হলেও চিকন চেহারার সিমসামের মাঝে বেশ ভালোই লাগছিল বিথিকে। বড় ভাই সুলভ আচরণ করে প্রশ্ন করলাম, তোমার রোল কত? খুব অল্প আওয়াজে জবাব দিল, তিন। বুঝতে বাকী রইলো না মেয়েটি বেশ মেধাবী ও ভদ্র স্বভাবের।
আন্টিকে বলছিলাম, আপনার মেয়েতো মেধাবী, তাকে ভালো কলেজে পড়িয়েন? জবাবে চোখমুখ ভরা হতাশা নিয়ে বললেন- বাবা, মেয়েকে তো পড়াতেই চাই, সেও পড়তে চায়। কিন্তু এসএসসি পাসও করাতে পারবো কিনা জানি না। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন কেন? জবাবে যা জানালেন তা সত্যিই হতাশ হওয়ার মতো তথ্য। মহিলার ভাষায়, প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়ে নিজে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার মেয়েটাকে জানোয়ারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কুলে যাতায়াতের তাওফিক দাও। এও বলি, যাওয়া-আসার পথে তুমি হেফাজত করো। কথা দিচ্ছি এসএসসির পর আর পাঠাবো না। কৌতুহলী হয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে বলেন, মেয়েটিকে আসা-যাওয়ার পথে সরকারদলীয় স্থানীয় এক ছাত্রনেতা নিয়মিত হয়রানি করে। নানা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে। কখনো কখনো গায়েও হাত দেয়। এছাড়া বিথিকে পথে দেখলে তার (ছাত্রনেতার) সঙ্গীদের কেউ ভাবি, কেউ মামি বা চাচি বলে ডাকে। এতে রাস্তায় বের হওয়া দুর্সাধ্য হয়ে ওঠে বিথির জন্য।
মেয়েটি জানায়, শুধু তাকে নয়। এই পথে যত মেয়ে স্কুলে যায় তাদের সবাইকে এভাবে হয়রানি করে ওই ছাত্রনেতা ও তার সহযোগীরা। এই জন্য স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে কেউ কেউ। জানতে চাইলাম পুলিশের সাহয্য নেয়নি কেন? জবাবে আন্টি শুধু বললেন, ওদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা কার আছে। থানা পুলিশ তো সব ওদের কেনা। আর মামলা করলেও পুলিশ কি সারাদিন আমার মেয়ের নিরাপত্তা দিবে?
এরই মধ্যে বাইরে তাকিয়ে দেখি আমার গন্তব্য পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। তাই দ্রুত নেমে গেলাম। আসার সময় মানিব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে আন্টির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, কোনো সমস্যায় পড়লে কল দিয়েন।
বাসায় এসেই বিভিন্ন জেলার কয়েকজন কাছের মানুষ থেকে তাদের এলাকার খোঁজ খবর নিলাম। জানতে পারলাম আমার নিজের জন্মস্থানসহ অনেক গ্রামেই এই সমস্যা মারত্মক আকার ধারণ করেছে। ভাবনায় পড়ে গেলাম, এই যদি হয় দেশের অবস্থা তাহলে কিভাবে চলবে। গ্রামাঞ্চলে কিভাবে উন্নত হবে শিক্ষার মান। আর বাল্য বিয়ে বন্ধ হবে কিভাবে? গ্রামাঞ্চলে এ অবস্থার কারণে মেয়ের অভিভাবকরা  আত্মসম্মান বাঁচাতে বাল্য বিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
এসব ভাবতে গিয়ে মনে পড়লো গত কয়েকদিন আগে বনানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থীর ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনা। মনে পড়ে, ছেলে বন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গভীর রাতে আবাসিক হোটেলে জন্মদিন পালন করতে গিয়ে কয়েকমাস পর কথিত ধর্ষণের অভিযোগ তুলে গণমাধ্যমের হেডলাইন হওয়ার ঘটনা। তারপর প্রশাসন, নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনসহ নানা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের একের পর এক পদক্ষেপ। কথিত ধর্ষকের গ্রেপ্তার হওয়া, আদালত, জেল, সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণসহ নানা ঘটনা। তার সঙ্গে মনে পড়ে বহুল আলোচিত কুমিল্লার তনু ও শরীয়তপুরের চাঁদনীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা। মনে পড়ে তাদের সহপাঠিদের বাঁধভাঙা চিৎকার আর বিচার না পাওয়ার কষ্ট। হায়রে তনু-চাঁদনী কেন যে তোরা ওই পাড়াগাঁয়ে জন্ম নিলি? এলি না কেন এই শহরে? এই শহরে এলে বিচারটাতো অন্তত পাইতি।
তনু-চাঁদনী নিয়ে আফসোস শেষ হওয়ার আগেই চোখে এলো বরিশালের বানারীপাড়ায় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির হাতে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনা। তাও লুকিয়ে বা জৈবিক কারণেও না। চাঁদা না পেয়ে দিন দুপুরে স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে সোনার ছেলে সুমন হোসেন মোল্লা। এ খবর শুনেই গণমাধ্যমগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম। কিন্তু হাতে গোনা দুএকটি গণমাধ্যম ছাড়া কোথাও দেখা মিললো না এই ঘটনার শিরোনাম।
তাই নিজে নিজেই জ্বপতে থাকলাম, গণমাধ্যমে শিরোনাম হয় না গ্রামের মেয়েরা, আর ধরা পড়েনা সোনার ছেলের দোষ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর