বৃষ্টির পানি মেটাবে প্রতিদিনের চাহিদা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঢাকা শহরে বছরে বৃষ্টি হয় ২ হাজার ২০০ মিলিমিটার। এ বৃষ্টিপাতের ৬০ শতাংশ যদি সংরক্ষণ করা যায় তাহলে শহরের ৮০ ভাগ পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন ২০০ কোটি লিটার ব্যবহার উপযোগী বৃষ্টির পানি পাওয়া সম্ভব হবে। যদিও এই সংরক্ষণের বিষয়টি পুরোপুরি গবেষণার টেবিল ও ‘পাইলট প্রজেক্ট’এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে গবেষকদের পরামর্শে সরকার ইতোমধ্যেই এই পানি সংরক্ষণে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়িয়ে পানি সংরক্ষণ করা গেলে ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে।
ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি ধরে তা ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সংশোধিত ‘ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবর্তন, সংরক্ষণ, অপসারণ) বিধিমালা-২০১৭’ এর খসড়ায় এ বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। বিধানটি কার্যকর হলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা রেখে ভবনের নকশা করতে হবে। একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক রাখতে বৃষ্টির পানি যাতে আবার মাটির নিচে চলে যেতে পারে, সে জন্য বাড়িতে কিছুটা খোলা জায়গা রাখার কথাও খসড়া বিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও নতুন ভবনে পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি নির্মাণ বাধ্যতামূলক করেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামনের দিনগুলোতে অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হবে, আবার খরাও দীর্ঘায়িত হবে। ফলে এখন থেকেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও তা ব্যবহারের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকা শহরে পানির স্তর প্রতি বছর তিন থেকে সাড়ে তিন মিটার করে নামছে।
অতিরিক্ত উত্তোলন:প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার ২২০ কোটি লিটার পানির চাহিদা মেটানো হয় ৫৮৬টি গভীর নলকূপ দ্বারা পানি উত্তোলনের মাধ্যমে। এসব গভীর নলকূপ নাগরিক চাহিদা অনুসারে বসানো হয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের স্তর ঠিক রাখার বিষয়ে খুব একটা নজর দেওয়া হয়নি। দৈনন্দিন পানির চাহিদার ৮৭ শতাংশ মেটানো হয় ভূ-গর্ভস্থ্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে। আর ১৩ শতাংশ পানির চাহিদা মেটে ভূ-উপরিভাগের পানি শোধন ও নদীর পানি ব্যবহারের মাধ্যমে।
ঢাকা ওয়াসা এবং ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের এলাকায় ৩০০ মিটারের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের তিনটি স্তর রয়েছে। বর্তমানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর ছাড়িয়ে চতুর্থ স্তর থেকেও কোথাও কোথাও পানি উত্তোলন করছে ওয়াসা। ঢাকার পানিস্তরের কেন্দ্র অঞ্চল তেজগাঁও, খিলগাঁও, বনানী, রমনা— এসব এলাকায় দ্বিতীয় স্তরের জলাধার থেকে পানি সরবরাহ হচ্ছে। এ স্তরের পানিও প্রায় ৮০ মিটার নিচে নেমে গেছে। অথচ রাজধানীর প্রান্তীয় এলাকায় এ পানির স্তর মাত্র ১৫ থেকে ২৫ মিটার নিচে। তৃতীয় স্তরে পানি উত্তোলনের জন্য অধিকাংশ গভীর নলকূপ মিরপুর এলাকায় বসানো হয়েছে। ফলে মিরপুর এলাকায় পানির স্তর অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশি নেমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)-এর ওয়াটার রিসোর্সেস প্ল্যানিং ডিভিশনের সিনিয়র ভূ-গর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমান দদেস্‌ হাওর বার্তাকে বলেন, ঢাকা কেন্দ্র অঞ্চলে এবং মিরপুর এলাকায় আশঙ্কাজনকভাবে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এর প্রধান কারণ, পানির স্তরের বিশ্লেষণ না করে বেসরকারিভাবে এবং বিক্ষিপ্তভাবে গভীর নলকূপ বসিয়ে ওয়াসার পানি উত্তোলন। আরেকটি কারণ হচ্ছে- প্রাকৃতিকভাবে পানি ভরে যাওয়া পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। সে কারণে রাজধানীর প্রান্তীয় এলাকার পানি গড়িয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকার ভূ-গর্ভের জলাধারে আসতে পারছে না। কৃত্রিম উপায়ে সে স্তরে পানি দেওয়ার বেশকিছু চেষ্টা হয়েছে। তবে তাতেও খুব কাজ হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ভূ-গর্ভের পানি তোলা কমিয়ে দৈনন্দিন কাজে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: বৃষ্টির পানি ছাদ থেকে পাইপের মাধ্যমে রিজার্ভারে পাঠানো হয়। এরপর ফিল্টার করে মূল রিজার্ভারে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পানি খাওয়া ছাড়া দৈনন্দিন যে কোনো কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন গোসল করা, কাপড় ধোয়া প্রভৃতি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার প্রতিদিন তার মোট খরচের ৪১ শতাংশ পানি ব্যয় করে গোসলের কাজে। আর ২২ শতাংশ কাপড় ধোয়া ও টয়লেট ব্যবহারে। আরেক হিসাবে দেখা গেছে প্রতিবার কমোডের ফ্ল্যাশে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পানি খরচ হয়। এতে পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার শুধু কমোড ফ্ল্যাশ করেই প্রতিদিন ৩৭৫ লিটার পানি খরচ করে।
ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোঃ মনোয়ার হোসেন বলেন, ইতোমধ্যেই ওয়াসার বেশকিছু ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পাইলট প্রজেক্ট করা হয়েছে। যা ইতিবাচক ফল দিয়েছে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, গ্রামে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে বহুকাল ধরেই। শহুরে জীবনে তা চালু করতে হবে। ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আই ডব্লিউ এম) কর্তৃপক্ষ বলছেন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ব্যবহার করা ও মাটির নিচের স্তরে পানি কৃত্রিমভাবে পুনর্ভরণ নিয়ে গবেষণা চলছে।
ভূ-গর্ভস্থ পানির বিশ্ব পরিস্থিতি:মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা (নাসা) বলছে, ভূগর্ভে যত পানি মজুদ আছে তার এক-তৃতীয়াংশই মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবে দ্রুত নিঃশেষ হওয়ার পর যে দুই তৃতীয়াংশ পানি থাকল তার সঠিক পরিমাপ কত (কত লিটার) সেটা স্পষ্ট জানা না গেলেও এই মজুদ পানির পরিমাপ এবং সেটা কত সময় পর্যন্ত মানুষ ব্যবহার করতে পারবে তা বের করার চেষ্টা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের ৩৭টি বৃহত্ পানির স্তরের মধ্যে ২১টির পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন গবেষকদের আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট আরও প্রকট হতে পারে।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর