যেভাবে বাংলাদেশের প্রশাসন গড়ে ওঠে. বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী

আমি ১৯৬৭ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগদান করি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সে সময়ে পাকিস্তানের সামরিক আদালত আমার অনুপস্থিতিতে বিচার করে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো পরিচালিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে ১৬২টিতে জয়লাভ করে। এটা ছিল কেন্দ্রে সরকার গঠনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অন্য কোনো দলের সমর্থন ব্যতিরেকেই তিনি সরকার গঠন করতে পারতেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন পদে যেসব বাঙালি অফিসার ও কর্মী চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন, তারা আওয়ামী লীগের এ বিজয়ে উৎফুল্ল ও আশান্বিত হন। কারণ তারা বাঙালিদের বঞ্চনা অন্য অনেকের চেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করার মতো অবস্থানে ছিলেন। এটাও মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক অনেক কম। সিএসপি অফিসারদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা অনেকেই ছিলেন অবাঙালি। জেলা প্রশাসক হিসেবে তারা নিয়োগ পেতেন বিপুল সংখ্যায়। এমনকি মহকুমা প্রশাসক হিসেবেও তাদের নিয়ে আসা হতো। এখানে কিছু তথ্য দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পাকিস্তান সরকারের সচিব পদে ১৪ জন ছিলেন বাঙালি, ৮৬ জন পশ্চিম পাকিস্তানি। জয়েন্ট সেক্রেটারি পদে বাঙালি ৬ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ৯৪ জন। ডেপুটি সেক্রেটারি পদে বাঙালি ১৮ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ৮২ জন। ৬০টি দেশে পাকিস্তানি মিশন প্রধানের মধ্যে মাত্র ৯ জন ছিলেন বাঙালি।
প্রশাসনে এভাবে দুর্বল অবস্থানে থেকেও কীভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশাসন এত দ্রুত গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল, সে প্রশ্ন সঙ্গত। এর একটি কারণ অবশ্যই গভীর দেশপ্রেম। আরও একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমরা প্রস্তুতির সময় পেয়েছিলাম এবং সেটা ঘটেছিল দুই পর্বে। প্রথম পর্ব ছিল ১ থেকে ২৫ মার্চ এবং দ্বিতীয় পর্ব এপ্রিল থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের আমল। ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ স্পষ্ট বুঝে যায় যে, একমাত্র পথ হচ্ছে স্বাধীনতা। এর পেছনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা অবশ্যই ছিল মুখ্য। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত তার ভাষণে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, এখন থেকে তার নির্দেশে চলবে প্রশাসন। তিনি পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সেটা পুরোপুরি মেনে চলা হয়। এ কারণে ২৬ মার্চ যখন স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে, তখন মনে হয়নি যে আমরা বিদ্রোহ করছি। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। ঢাকা এবং কয়েকটি জেলা থেকে সরকারি প্রশাসনে যুক্ত একদল বিভিন্ন সময়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেই। এভাবে সেখানে একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগ-দপ্তর গড়ে তুলতে থাকে। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠা হয় সাধারণ প্রশাসন বিভাগ। পরে পররাষ্ট্র, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, মন্ত্রিপরিষদ, প্রতিরক্ষা_ এসব মন্ত্রণালয় সংগঠিত হতে থাকে। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন অনুযায়ী অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়। এক পর্যায়ে পরিকল্পনা কমিশনও গঠিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তার আগেই মুক্তাঞ্চলগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্ত হয় যশোর জেলা। সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে ওয়ালিউল ইসলামকে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন।
আগেই বলেছি, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন সীমিত সংখ্যক। আমাদের লজিস্টিক সাপোর্টও ছিল অপর্যাপ্ত। আমি একাধিক মন্ত্রণালয়ের কাজে যুক্ত ছিলাম এবং কোনো কোনো সময়ে টেবিল-চেয়ারের অভাবে ইজি চেয়ারে বসে লিখেছি। দেশ মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজন পড়ে। প্রাদেশিক সরকারের আমলে এ অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। তবে আমরা দ্রুতই এসব শিখে নিতে সক্ষম হই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোনো সেটআপ কার্যত ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন দূতাবাস থেকে যেসব বাঙালি কর্মকর্তা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন তারা উদ্যোগী হন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার নানাভাবে সক্রিয় সহায়তা দিয়েছে। তারা নিশ্চিত ছিল যে, ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হতে চলেছে। তবে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে কারও কারও শঙ্কা ছিল যে, বাংলাদেশের ভেতরে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে। প্রশাসন কীভাবে চলবে, সেটা নিয়েও কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ ধরনের শঙ্কা ছিল স্বাভাবিক। তারা জানতেন যে, পাকিস্তানে বাঙালি অফিসার খুব বেশি ছিল না। এদের একটি অংশকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং তাদের সঙ্গে এ দেশের একদল দালাল যোগ দেওয়ায় জনগণের একাংশের মধ্যে প্রতিহিংসার মনোভাব দেখা দিতে পারে। এসব কারণে ভারত সরকার অভিজ্ঞ ভারতীয় বাঙালি আইসিএস অফিসারদের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রথমে ভাবা হয় তারা জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করবেন। পরে ঠিক হয়, লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাবেন। এর ফলে বাংলাদেশ সরকারের অফিসারদের মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকারের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা এবং আমাদের কর্মকর্তারা দ্রুত নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নিতে থাকায় তিন-চার মাসের মধ্যেই ভারতীয় অফিসারদের আর কোনো কাজ থাকে না এবং তারা স্বদেশে ফিরে যান।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য প্রথম দিকে বড় সমস্যা ছিল পুনর্গঠন। সড়ক ও রেল যোগাযোগ ছিল বিপর্যস্ত। বিমানবন্দরগুলো অচল হয়ে পড়েছিল। পুনর্গঠন কাজে অর্থের অপ্রতুলতা ছিল। বৈদেশিক সহায়তাও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ছিল না। শুরুর দিকে ভারত সরকার অনুদান প্রদান করেছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। একাধিক দেশে থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় এ ভাণ্ডারে অর্থ জমার ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধু তখন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। তারা আশু কাজের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলোও নির্ধারণ করতে পারেন। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিষয়ে তারা বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করেন।
এভাবে ১৯৭৪ সাল নাগাদ একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রশাসনিক কাঠামো মোটামুটি দাঁড়িয়ে যায়। এজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকেই অবদান রেখেছেন। আর সবকিছুর মূলে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা। তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল। কোনো সমস্যা দেখা দিলেই তার কাছে পরামর্শ চাওয়া হতো। বলা যায়, তার উপস্থিতির কারণে যে কোনো সমস্যা আমরা সহজে মোকাবেলা করতে পারি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জন্য কঠিন কাজ ছিল অর্থনৈতিক পুনর্গঠন। আমাদের অর্থনীতির ভিত ছিল দুর্বল। পাকিস্তানিদের মালিকানায় যেসব শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছিল, সেগুলো পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত জানান। সে সময়ের বাস্তবতায় এটা ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত এবং অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। এসব প্রতিষ্ঠান চালানোর ক্ষেত্রে আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ছিল না। অনেকে কাজ করতে শিখেছেন। তারপরও তারা যেভাবে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন, সেটা বেসরকারি খাতের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এটা মনে রাখতে হবে, আমাদের বেসরকারি খাতও সে সময়ে দুর্বল ছিল। তাদের হাতে এসব প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিলে আরও অব্যবস্থাপনার শঙ্কা ছিল।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাস্তববাদী মানুষ এবং উদার। তিনি নির্দিষ্ট ছক ধরেই চলতে হবে_ এমনটি বিশ্বাস করতেন না। সে সময়ে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী ধরনের হবে সেটা নিয়ে বিতর্ক ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন যে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তুলতে তাদের সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি প্রশাসনিক কাঠামোর বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে সব মহকুমাকে জেলায় পরিণত করেন এবং গভর্নর পদ সৃষ্টি করেন। এ পদক্ষেপ সঠিক কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেই এ সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। কিন্তু মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই মহকুমাগুলোকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আমাদের কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে উঠেছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন বিস্তৃত হয়েছে। দক্ষতা বেড়েছে। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে। এ অর্জনের পেছনে অনেক মানুষের অবদান রয়েছে। তবে সূচনা পর্যায়ে আমরা যারা যুক্ত ছিলাম, তারা এজন্য নিশ্চিতভাবেই গর্ব অনুভব করতে পারে।
সসাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর