কেন এই জলাবদ্ধতা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বছরের পর বছর ধরে চলে আসা দখলের সংস্কৃতি থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি রাজধানীর খাল-জলাশয়। একের পর এক খাল-জলাশয় ধ্বংস করা হচ্ছে। বিপরীতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া রাজধানীর জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একে তো পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত পথ নেই, তার ওপর বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সময়ে-অসময়ে নগর বন্যায় ভাসছে ঢাকা। বৃষ্টিমুখর দিনে দীর্ঘস্থায়ী জলজট এবং দীর্ঘ যানজটসহ নানা ভোগান্তি এখন নগরবাসীর জন্য অবধারিত বলেই মত দিয়েছেন তারা। সূত্র মতে, রাজধানীর জলাধার রক্ষায় কাগজে-কলমে শক্ত নীতি থাকলেও মাঠ পর্যায়ে এর কোনো প্রতিফলন নেই। ঢাকা নিয়ে করা সব পরিকল্পনাতেই জলাধার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানে ওয়াটার রিটেনশন পন্ড বা জলাশয় রাখার কথা ছিল। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানেও (ড্যাপ) জলাভূমি চিহ্নিত করা ছিল। রাজউকের নতুন স্ট্রাকচার প্ল্যানেও বলা হয়েছে জলাধার সংরক্ষণের কথা। অথচ বাস্তব চিত্রটা একেবারে উল্টো। একের পর এক পরিকল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দখল ও ধ্বংস করা হয়েছে বিভিন্ন জলাধার। অত্যন্ত  কম সময়ের ব্যবধানে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে ঢাকার খাল-জলাশয় ও নিম্নভূমি। জলাধার দখল ও ধ্বংসের এ ধারাবাহিকায় ছেদ ফেলতে পারেনি আদালতের নির্দেশও। এভাবে সব আইন, পরিকল্পনা ও নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একের পর এক জলাশয় মেরে ফেলায় এখন সময়ে অসময়ে নগর বন্যায় ভাসছে ঢাকা। গত কয়েক দিনের বর্ষণে ঢাকা জুড়ে জলজটের ভয়াবহ চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। গতকালের সকাল থেকে দুপুর অব্দি টানা বর্ষণে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবে যায় রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো। জলজটের এমন ভয়াবহতার শিকার হয়েছে সড়কে চলা যানবাহনগুলো। মহাভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। জানা গেছে, ঢাকায় ১৯৭১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫০টি খালের অস্তিত্ব ছিল। গত তিন দশকে এ সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি খাল মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট খালগুলোর মধ্যে চারটির অংশ স্বীকৃতি পেয়েছে লেক হিসেবে। ঝিগাতলা-শুক্রাবাদ খালটির ধানমণ্ডি অংশের নাম হয়েছে ধানমণ্ডি লেক, সেগুনবাগিচা খালের নাম হয়েছে রমনা লেক, বেগুনবাড়ি খালের নাম হয়েছে হাতিরঝিল এবং আবদুল্লাহপুর খালের কিছু অংশ নিয়ে হয়েছে উত্তরা লেক। অন্যগুলো পেয়েছে নর্দমার আকৃতি। রাজধানীর বাবুবাজার থেকে সূত্রাপুর পর্যন্ত চন্দ্রাকৃতির বেশ প্রশস্ত ও গভীর ধোলাইখাল ছিল। কিন্তু সেটাকে বক্স কালভার্ট করে ফেলা হয়েছে। পান্থপথের খালটি ধানমণ্ডি থেকে হাতিরঝিলে পতিত হতো। সেটাকে বক্স কালভার্ট করে রাস্তা বানানো হয়েছে। পুকুর, লেক, খালের পাশাপাশি ঢাকা শহরের ভেতরে ও আশপাশে অনেক নিম্নভূমি ছিল। এগুলোই ঢাকার মূল জলাধারের কাজ করত। শহরের ভেতরের নিম্নভূমিগুলো ছিল রূপনগর, রামপুরা, কল্যাণপুর। এগুলো ইতোমধ্যে ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। এখন ক্রমাগতভাবে ভরাট হয়ে চলছে আশপাশের নিম্নভূমিগুলো। এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৬০ সালে ঢাকা শহরে জলাশয় ও নিম্নভূমি ছিল ১৬ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৬ হেক্টর। ১৯৮৮ সালে তা কমে হয় ১৪ হাজার ৮২১ দশমিক ৩৫ হেক্টর। ২০০৮ সালে তা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৯ হেক্টরে। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ আরও কমে হয় ৯ হাজার ৩২৫ হেক্টর। ১৯৬০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ হ্রাসের পরিমাণ ৬২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০১০ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদফতর রাজধানীর খাল-জলাশয় উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। কিন্তু সেই অভিযান বেশিদূর এগোয়নি। উচ্ছেদ প্রস্তুতি পর্বে ২৬টি খালের পাশে ১ হাজার ১০০ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু সেগুলো থেকে স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নানামুখী বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আবার উদ্ধার করা খালের জায়গায় দ্রুততার সঙ্গে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করে ফেলা হয়েছে। দখলদাররা এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় উচ্ছেদ করতে গেলে বাধা এসেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল রাখতে নগরীর ড্রেনগুলোতে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা যেমন জরুরি একইভাবে এ পানি কোথায় গিয়ে পড়বে, সেটাও নিশ্চিত করা জরুরি। অথচ এ দুটি কাজের কোনোটিই সুষ্ঠুভাবে হয়নি এখানে। নগরীর দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও জলাধার সংরক্ষণের ব্যবস্থা না হওয়ায় দিনকে দিন সেগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় ঢাকায় জলজট এখন নিত্য দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। নানা সময়ে খালগুলোকে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, নিচু ভূমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা। এখন তার খেসারত গুনতে হচ্ছে নগরবাসীকে। স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে ঢাকা শহরের খাল, বিল, ঝিলসহ বিভিন্ন ধরনের জলাশয় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পয়ঃনিষ্কাশনের জরুরি অনুষঙ্গগুলো সংরক্ষণে যথাযথ আইন থাকলেও তা প্রয়োগ হচ্ছে না। রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার মধ্যে কাজের কোনো সমন্বয় নেই। ফলে জলাবদ্ধতার সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম বলেন, আগে বৃষ্টির পানি কিছু যেত মাটির নিচে, কিছু চলে যেত নদীতে। কিন্তু নগরায়নের ফলে এখন পানি ঠিকমতো নিচে যেতে পারছে না। আর খাল-বিল-জলাশয় ভরাটের কারণে পানি নদীতেও যেতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে তার অবস্থাও খুবই নাজুক। পানিটা তাহলে কোথায় যাবে? এরপরও আমরা ক্রমশ জলাশয় ভরাট করেই চলেছি। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের খাল, জলাশয় সংরক্ষণের জন্য আইন আছে। ১২ থেকে ১৫ শতাংশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ আধার থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু রাজউক, ওয়াসা কিংবা সিটি করপোরেশন এগুলো করতে পারেনি। শুধু খাল-জলাশয় দখল ও আবকাঠামোগত দুর্বলতাই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে, যা রাজধানীর জলজটের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে, অর্থাত্ অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, দুর্বল অবকাঠামো অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টির চাপ নিতে পারছে না। ঢাকার মতো শহরে, যেখানে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অতিশয় দুর্বল, সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র দুর্ভোগ। ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী জলজট এবং অবধারিত যানজট। এদিকে পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল জলজটের সমস্যা ও সামাধান প্রসঙ্গে সকালের খবরকে বলেন, ঢাকা শহরের জলজটের পেছনে প্রধানত দুটি কারণ রয়েছে। এর একটি হল-প্রাকৃতিক খালগুলো দখল হয়ে যাওয়া এবং অল্প কিছু যা আছে সেগুলোর সঙ্কীর্ণ হয়ে পানি বহন ক্ষমতা কমে আসা। দ্বিতীয়ত, বৃষ্টির পানি নদীতে যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে যেসব বক্স কালভার্ট করা হয়েছিল, সেগুলো প্রায় অকার্যকর। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে প্রায় সারা বছর বিশৃঙ্খলভাবে নির্মাণকাজ চলছে। অব্যবস্থাপনার কারণে বিভিন্ন ধরনের নির্মাণসামগ্রী ফেলে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ করা হচ্ছে। এসব দেখার যাদের দায়িত্ব তারা অকার্যকর। ঢাকার জলজট নিরসনে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বৃষ্টির পানি যাতে নদীতে যেতে পারে সেজন্য একটা নকশা করতে হবে। এই নকশা তৈরির কাজ একমাত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডই পারবে। নকশা তৈরির পর সে অনুযায়ী এগোতে হবে। এজন্য অনেক বাড়িঘর ভাঙতে হতে পারে। বাসযোগ্য ঢাকার জন্য প্রয়োজনে তাই করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর