দিনে ২ জন ধর্ষণের শিকার ৬ মাসে মামলা ১০,০০০

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেড়েই চলছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। বাড়ছে খুন, ধর্ষণের ঘটনাও। দুর্বৃত্তদের পাশবিকতা থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। গত কয়েক মাসে খোদ রাজধানীতেই একাধিক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরতে মাইক্রোবাসে তুলে, বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে, এমনকি স্বামীকে অতিরিক্ত মদ্যপান করিয়ে মাতাল করে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর উত্তরায় এক কিশোরীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তিন সহযোগীসহ গণর্ধষণ করে কিশোরীর কর্মস্থলের এক সহকর্মী। আর শনিবার রাতে রাজধানীর রায়েরবাজার ও মিরপুরে পৃথক ঘটনায় দুই শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত ছয় মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অন্তত ১০ হাজার মামলা হয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজে মূল্যবোধের অভাব এত প্রকট হচ্ছে যে মানুষ তার মানবিকতাবোধ হারিয়ে ফেলছে। এ কারণে তরুণী ও মহিলার পাশাপাশি শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অপরদিকে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে অপরাধ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। ধর্ষণের অনেক ঘটনায় সামাজিক সম্মানের কারণে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘমেয়াদি বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এই সুযোগে ধর্ষকরা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। এসব দেখে অন্যরা অপরাধ কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হয়। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দ্রুত বিচার সম্পন্ন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমেই কেবল ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ রোধ করা সম্ভব।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য মতে, গত জুলাই মাসে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ৫৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন দুটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া জুন মাসে ৬৫টি, মে মাসে ৮২টি, এপ্রিল মাসে ৪৩টি, মার্চ মাসে ৪১টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৪ ও জানুয়ারি মাসে ৩৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে ধর্ষণের পৃথক কোন পরিসংখ্যান নেই। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলি একসঙ্গে হিসাব করা হয়। সেই হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ১০ হাজার ৩২৪টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ধর্ষণের বলে জানা গেছে। এর মধ্যে খোদ রাজধানীতে ঘটে যাওয়া প্রায় সাত শতাধিক ঘটনার উল্লেখযোগ্য হলো ধর্ষণের ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ একটি সংস্থার হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ১০৮ ধর্ষণের ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বেড়েই চলছে। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই ধর্ষণের মতো ঘটনা বেশি ঘটছে। তারা বলছেন, শিশু বা নারী যেই ধর্ষণের শিকার হোক না কেন প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনাই স্পর্শকাতর। এজন্য ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে বিশেষভাবে দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে আদালতে চার্জশিট ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা উচিত। একই সঙ্গে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির স্থাপন করতে পারলে ধর্ষণের ঘটনা কমে যাবে। এ ছাড়া সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো অপরাধগুলি রোধ করা সম্ভব নয়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধর্ষণের ঘটনায় কমপক্ষে দুজন সাক্ষী কিংবা আদালতে গিয়ে নতুন করে ধর্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার ভয়ে অনেকেই আসামি পক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন। এ কারণে ধর্ষকেরা সহজেই পার পেয়ে যায়। এ ছাড়া সামাজিকতা বা সামাজিক সম্মান ধর্ষকদের শাস্তি পেতে বড় একটি বাধা। কারণ সামাজিক সম্মানের ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী পরিবার আদালত পর্যন্ত যেতে চায় না। ধর্ষণের শিকার যদি তরুণী বা কিশোরী হয় তাহলে তো বিষয়টি পরিবার থেকে গোপন করার চেষ্টা করা হয়। এর কারণ হলো ধর্ষিতা তরুণীকে সমাজে ভিন্ন চোখে দেখার প্রবণতা রয়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, কোন অপরাধ ঘটলে যেরকম ফলাও করে সারা দেশে প্রচারিত হয় তেমনি ওই অপরাধের শাস্তিটাও ফলাও করে প্রচার করা উচিত। কারণ একটি অপরাধ দেখেই অন্যদের সুপ্ত অপরাধ মন জাগ্রত হয়ে অপরাধ করতে ঠেলে দেয়। তেমনি যদি তার সামনে অপরাধের শাস্তির বিষয়টি সামনে আসে তাহলে সে অপরাধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবে। এজন্য ধর্ষণ বা নারী নির্যাতের ঘটনাগুলিতে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। একই সঙ্গে অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না সেই বার্তাটি সকলস্তরে পৌঁছানো উচিত। তাহলেই কেবল ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ কমানো সম্ভব।
চলতি বছরের ২১শে মে রাজধানীর কুড়িল এলাকায় গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরতে গিয়ে গণধর্ষণের এই ঘটনাটি নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা তরুণী নিজেই বাদী হয়ে রাজধানীর ভাটারা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় র‌্যাব দুই ধর্ষক লাভলু ও তুষার নামে দুই ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে। মামলাটির তদন্তভার থানা পুলিশের কাছ থেকে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, মামলাটির তদন্ত চলছে। খুব শিগগিরই আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হবে। সর্বশেষ উত্তরায় গণধর্ষণের ঘটনাটিতে চার ধর্ষকের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূল জবানবন্দি দিয়েছে। প্রধান আসামি মেহেদী হাসান আরিফকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। হায়দার নামে অপর এক আসামি পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বিপ্লব কুমার শীল জানান, আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আর পলাতক হায়দারকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। হায়দারকে ধরতে পারলে যত দ্রুত সম্ভব মামলার চার্জশিট দিয়ে দেয়া হবে। এ ছাড়া জুলাই মাসে রাজধানীর লালবাগে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে এক কিশোরী ও সূত্রাপুরে স্বামীকে অতিরিক্ত মদ্যপান করিয়ে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
২২শে জুন জামালপুর থেকে ঢাকার খিলক্ষেতে চাকরির দেয়ার নাম করে এক তরুণীকে হানিফ ও কামাল নামে দুই যুবক ধর্ষণ করে। একদিন আগে গত ২১শে জুন মিরপুরে এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন কলেজছাত্রী। ধর্ষকরা ওই কলেজছাত্রীর নগ্ন ভিডিও করে তার কাছে চাঁদাও দাবি করে। ২০শে জুন নোয়াখালীতে চলন্ত বাসে এক কিশোরী বধূকে গণধর্ষণ করা হয়। ১৮ই জুন দিনাজপুরের এক তরুণীকে গণধর্ষণ করা হয়। এর আগে গত ১২ই জুন রাজধানীর রামপুরা উলনে খালার বাসায় বেড়াতে এসে গণধর্ষণের শিকার হন এক নারী। দুর্বৃত্তরা ওই নারীর স্বামীকে বেঁধে রেখে তাকে ধর্ষণ করে। ১২ই জুন সিরাজগঞ্জের তাড়াসে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ১১ই জুন নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় ৮ম শ্রেণীর এক ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়। ৮ই জুন নরসিংদীতে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে ৪ জন মিলে গণধর্ষণ করে। ৫ই জুন নওগাঁয় এক স্কুলশিক্ষিকা ও তার বড় বোনকে তাদের নিজ বাড়িতে স্বামী ও তার তিন বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে। ২রা জুন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে সদ্য এসএসসি পাস করা এক ছাত্রীকে তার প্রেমিক হৃদয় ও তার দুই বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ঘটনার বেশির ভাগেরই আসামিরা পলাতক রয়েছে। পুলিশ আসামিদের ধরতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা হয় সেসব ঘটনাই কেবল গুরুত্ব দিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যগুলোতে পুলিশ গা’ করে না। আসামিরাও কিছুদিন পালিয়ে থাকার পর ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে আপসরফা করে ফেলে।
এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর