ত্রাণ নয়, আমরা পরিত্রাণ চাই

বার বার পানিতে ডুবছি। পাহাড়ি ঢলের স্রোতে ভেসে গেছে বসতবাড়ি। পরনের কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি আট দিন আগে। জানিনা ঘর আছে, নাকি জায়গা আছে। নিশ্চিত পানিতে ভেসে গেছে আমার পালিত হাঁস-মুরগি গুলো। তৃতীয় বারের মতো এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব। এভাবে বার বার সব কিছু হারিয়ে শুধু ত্রাণ হিসাবে চাল নিয়ে কি হবে। এই ত্রাণ নিয়েতো আর জীবন রক্ষা করা যাবে না। জীবন রক্ষা করতে প্রয়োজন পরিত্রাণ।’ এসব কথা বলছিলেন কক্সবাজারের রামু উপজেলা সদরে রামু খিজারী উচ্চ বিদ্যালয়ে আট দিন ধরে আশ্রয় নেয়া পূর্ব মেরংলোয়া এলাকার আরফা বেগম (৩৫)।
ওই আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা আবুল কাশেম (৪৫) বলেন, ‘টানা তিন দফা বন্যার পানিতে ভেসে গেছে তাদের অর্জিত সব সম্পদ। বিনিময়ে পেয়েছি কয়েক কেজি চাল। আমরা এক কেজি/দুই কেজি চাল চাইনা। বন্যা থেকে পরিত্রাণ চাই। মানুষের মতো বাচঁতে চাই।’
‘ত্রাণ নয়, আমরা পরিত্রাণ চাই’হাইটুপী এলাকার ছৈয়দ আহমদ বলেন, ‘রামুর বাঁকখালী হাইটুপী এলাকায় বন্যার পানি ও জোয়ারের ধাক্কায় মাত্র তিনশ’ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ওই ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে বন্যার পানি, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে বার বার ডুবে যাচ্ছে কয়েকশ’ গ্রাম। তলিয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি ও গাছপালা। গত একমাস আগেও বেড়িবাঁধে ভাঙ্গা ছিল মাত্র একশ’ মিটার। অল্প এই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করায় জোয়ারের পানিতে ভাঙ্গার পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এক মাসে তিন দফা বন্যা হয়েছে।’
শুধু আরফা বেগম, আবুল কাশেম ও ছৈয়দ আহমদ নয়, কক্সবাজারের রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, মহেশখালী ও কক্সবাজার সদরের লাখ লাখ মানুষ ত্রাণ নয়, আর্তি জানাচ্ছেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য।
দুর্গত এলাকার এসব মানুষের দাবি, সরকার এখানকার মানুষের জন্য কিছুই করছে না। মানুষ তো ত্রাণ চাইনা। ভালোভাবে বাঁচতে চায়। সরকার বন্যা মোকাবেলায় বেড়িবাঁধ, নদী সংরক্ষণ তীর নির্মাণ, নদী ড্রেজিং, দখলমুক্ত করা, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে এমন ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে মানুষ রক্ষা পেত। কিন্তু এসব কিছুই করছে না সরকার।
দুর্গত মানুষ এখন ত্রাণ নয়, এ দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ চায় উল্লেখ করে রামু উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম জানান, গত একমাসে টানা তিন দফা বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে রামুর ৫ টি ইউনিয়ন। বন্যার পানি ও জোয়ারের ধাক্কায় ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের একটি বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান শেফায়েত আজিজ রাজু জানান, পেকুয়ার চারদিকে বেড়িবাঁধের ১০ টি পয়েন্টে ভয়াবহ ভাঙ্গনে লোকালয় এখন জোয়ার ভাটায় পরিণত হয়েছে। মাতামুহুরি নদীতে লামা ও আলীকদম থেকে নামা পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় বার্মার টেক, তেইল্যাকাটা, পুরুইত্যাখালী রাবার ড্যাম এলাকা, মগনামা ইউনিয়নের কাকপাড়া, শরতঘোনা, উত্তর পাড়া ও উজানটিয়া ইউনিয়নের টেকপাড়ার বেড়িবাঁধ সর্ম্পূণ ভেঙ্গে গেছে। উক্ত ভাঙ্গা অংশ দিয়ে বার বার জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে হাজারো গ্রাম।
‘ত্রাণ নয়, আমরা পরিত্রাণ চাই’বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে চকরিয়ার কোনাখালী, বিএমচর, পুর্ববড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, বদরখালী ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। এসব ইউনিয়নের লাখো মানুষ এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। আশ্রিত এসব মানুষের মাঝে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হলেও তাদের দাবি পরিত্রাণ। কখন তারা বার বার এই দুর্ভোগ ও ক্ষতিগ্রস্থ থেকে পরিত্রাণ পাবে। মহেশখালীর মাতারবাড়ি মগডেইল, রাজঘাট, ফুলজানমুরা, ছোট মহেশখালীর তেলিপাড়া, মুদিরছড়া, কুতুবজোমের তাজিয়াকাটা, সোনাদিয়া, ঘটিভাঙ্গা, পৌর এলাকার হুনায়ার ছড়া, চরপাড়া গোরকঘাটা ইউনিয়নে পানিবন্দি মানুষের মাঝেও উঠেছে পরিত্রাণের দাবি।
কক্সবাজার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও সদরে ৪০টি ইউনিয়ন বন্যা ও জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব লোকজনের জন্য ৫’শ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানিয়েছেন, টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে রামু, পেকুয়া ও চকরিয়া উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকায় যদি বেড়িবাঁধে ভাঙ্গন না থাকলে ক্ষতির পরিমাণ আরও কম হতো। এখন কিভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর