বৃষ্টির সময় নবীজির সুন্নত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  আল্লাহই বায়ু পাঠান,
অতঃপর সেই বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে। অতঃপর আমি তা মৃত ভূখ-ের দিকে পরিচালিত করি, অতঃপর তা দ্বারা সেই ভূখ-কে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করে দিই।
এমনিভাবে হবে
পুনরুত্থান। বৃষ্টি দেখে মোমিনের হৃদয়ে ঈমান জাগরুক হয়, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। মোমিন বুঝতে পারে, এই যে মেঘমালা আকাশে ঘুরছে, সমুদ্রের পানি বাষ্প হয়ে জমাটবদ্ধ হচ্ছে এবং মেঘ হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে পানি সরবরাহ করছে, একমাত্র আল্লাহই এসব করতে সক্ষম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদের সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা?’ (সূরা মুলক : ৩০)। ‘আল্লাহই বায়ু পাঠান, অতঃপর সেই বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে। অতঃপর আমি তা মৃত ভূখ-ের দিকে পরিচালিত করি, অতঃপর তা দ্বারা সে ভূখ-কে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করে দিই। এমনিভাবে হবে পুনরুত্থান।’ (সূরা ফাতির : ৯)। ‘আমি মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি, যাতে তা দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও পাতাঘন উদ্যান।’ (সূরা নাবা : ১৪-১৬)।
একটি প্রশ্ন হলো, বৃষ্টির সময় নবীজি কী করতেন? এক্ষেত্রে তাঁর সুন্নত কী ছিল? মেঘবৃষ্টি ও ঝড়-তুফানের সময় নবীজি (সা.) কিছু বিশেষ কাজ করতেন, সেগুলোই নবীজির সুন্নত হিসেবে আমাদের কাছে অনুসরণীয়।
এক. প্রথম সুন্নতটি ঈমান ও বিশ্বাস এবং বুদ্ধি ও বিবেক সংক্রান্ত। একজন মুসলমানের এ বিশ্বাস থাকতে হবে যে, মেঘবৃষ্টি আল্লাহর সৃষ্টি, সৃষ্টিজগতের প্রতি তাঁর অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। এটা প্রাকৃতিকভাবে অথবা ভিন্ন কোনো উপায়ে এমনিতেই সৃষ্টি হয় না। হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে নবীজি (সা.) একদিন বৃষ্টির পর সাহাবিদের নিয়ে ফজর আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবিদের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান তোমাদের প্রতিপালক কী বলেছেন? সাহাবিরা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই বেশি জানেন। নবীজি বললেন, আল্লাহ বলেন, অবস্থা এমনও হয় যে, আমার বান্দাদের কেউ মোমিন হয়ে আর কেউ কাফের হয়ে ভোরে ওঠে। যে বলে, আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী প্রমাণিত হলো। আর যে বলল, অমুক অমুক নক্ষত্রের বদান্যতায় আমরা বৃষ্টি পেয়েছি, সে সেই নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী এবং আমার প্রতি অবিশ্বাসী সাব্যস্ত হলো। (বোখারি : ১০৩৮)।
দুই. হৃদয় ও অনুভূতিসংক্রান্ত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য বৃষ্টিকে যেভাবে একটি বিরাট নেয়ামত বানিয়েছেন, তিনি চাইলে সেটাকে আবার মহাসংকটের কারণও বানাতে পারেন। পানি যখন পরিমিত পরিমাণে বর্ষিত হয়, তখন সেটা নেয়ামত। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের ওপর অসন্তুষ্ট হলে এমন বেশি পরিমাণে পানি বর্ষণ করেন, যাতে মানুষের জন্য থাকে কষ্ট ও দুর্ভোগ। কোরআন মাজিদ থেকে আমরা জানতে পারি, নুহ (আঃ) এর সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছে বন্যায় প্লাবিত হয়ে এবং ইয়েমেনে সাবা জাতি ধ্বংস হয়েছে একটি বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ার কারণে। আজও মিডিয়ার বদান্যতায় আমরা দুনিয়ার যত দুর্যোগ ও দুর্ভোগের খবর শুনতে পাইÑ বেশিরভাগ পানির কারণে, অতিমাত্রায় ঝড়বৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন ও সুনামি প্রভৃতির কারণে। এজন্য নবীজি (সা.) বৃষ্টির পূর্বমুহূর্তে প্রবাহিত বাতাস দেখলে দোয়ায় মগ্ন হতেন; এ বাতাস যেন শাস্তির কারণ না হয়। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, মেঘ দেখলে নবীজির চেহারা মোবারক বিবর্ণ হয়ে যেত এবং তিনি ভয়ে কখনও ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেন, কখনও বাইরে আসতেন। আর যখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যেত তখন তার চেহারায় আনন্দ প্রকাশ পেত। আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সব লোকই যখন বৃষ্টির আলামত মনে করে মেঘ দেখে খুশি হয়, আপনার মধ্যে তখন এক ধরনের বিচলিত ভাব দেখতে পাই? নবীজি বললেন, ‘আয়েশা! এটা তো হতে পারে এমন, যেভাবে আদ সম্প্রদায় মনে করেছিল! অতঃপর তারা যখন শাস্তিকে মেঘরূপে তাদের উপত্যকা অভিমুখী দেখল, তখন বলল, এ তো মেঘ, আমাদের বৃষ্টি দেবে। বরং এটা সেই বস্তু; যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা বায়ু; এতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সূরা আহকাফ : ২৪, মুসলিম : ৮৯৯)।
তিন. বাচনিক সুন্নত সংক্রান্ত। হজরত আয়েশা (রা). বলেন, ঝড়ের বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে দেখলে নবীজি (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছ থেকে এ বাতাস, এর মধ্যে যা কিছু আছে এবং যার জন্য এ বাতাসকে পাঠানো হয়েছেÑ ওইসব কিছুর মঙ্গল কামনা করছি। আর এ বাতাসের মধ্যে যা কিছু আছে, যার জন্য এই বাতাসকে পাঠানো হয়েছেÑ ওইসব কিছুর অমঙ্গল থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (মুসলিম : ৮৯৯) নবীজি বলেন, ‘যখন তোমরা গর্জন শুনতে পাও, তখন আল্লাহর তাসবি পাঠ করো।’ (মারাসিলে আবু দাউদ : ৫৩১)। নবীজি আরও বলেন, ‘দুইটি দোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় না : আজানের সময় এবং বৃষ্টির নিচে।’ (মুসতাদরাকে হাকিম : ২/১২৪)। বৃষ্টি প্রবল হলে এবং তা আল্লাহর গজবে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা দেখলে নবীজি দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের ওপর নয়, আশপাশের ওপর; টিলার ওপর, উপত্যকার ভেতর, গাছপালার বাগানে পানি বর্ষণ করুন।’ (মুসলিম : ৮৯৯)।
চার. বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে সুন্নত পালন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি আকাশ থেকে বরকতময় বৃষ্টি বর্ষণ করি।’ (সূরা কাফ : ৯)। যেহেতু বৃষ্টি আল্লাহ প্রদত্ত বরকত, সেজন্য নবীজি বৃষ্টির সময় নিজের শরীর থেকে কিছু কাপড় খুলে ফেলতেন, যাতে বৃষ্টির পানি শরীরে লাগতে পারে। এ ব্যাপারে তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো আল্লাহর নিত্যনতুন সৃষ্টি। (মুসলিম : ৮৯৮)। অর্থাৎ এটা ওইমাত্র আল্লাহ বর্ষণ করলেন, তাই বরকত হাসিলের আশায় তিনি এমনটা করতেন। বৃষ্টি হলে হজরত ইবন আব্বাস (রা.) তাঁর জিনিসপত্র ঘরের বাইরে রেখে দিতেন। যাতে বরকতময় পানি তাতে পৌঁছায়। (আল আদাবুল মুফরাদ : ১২২৮)।
এগুলো হচ্ছে বৃষ্টি আসার আগে প্রবাহিত বাতাস এবং তারপর বৃষ্টি বর্ষিত হওয়ার সময় নবীজির কয়েকটি সুন্নতের সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
যেভাবে পূর্বে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বৃষ্টি মূলত আল্লাহর এক নেয়ামত। অনাবৃষ্টি আর পানির অভাবে আজ পৃথিবীর কত দেশে মানুষ হাহাকার করছে। কেনিয়া, সোমালিয়া প্রভৃতি আফ্রিকান দেশে মানুষ বৃষ্টির জন্য আহাজারি করছে। পানির অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। জনপদগুলো মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা এ বৃষ্টি নেয়ামতকে কিছু বিশেষ গুণ ও কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন। যেমন :
১. বৃষ্টি নেয়ামত ঈমান ও তাকওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নিয়ামতগুলো উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদের পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের কারণে।’ (সূরা আল আরাফ : ৯৬)।
২. শুধু ঈমান ও আমলই যথেষ্ট নয়, বরং তার ওপর অটল ও অবিচল থাকার সঙ্গেও এ নেয়ামত সম্পৃক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর এ প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যে, তারা যদি সত্যপথে কায়েম থাকত, তবে আমি তাদেরকে প্রচুর পানি বর্ষণে সিক্ত করতাম।’ (সূরা আল জিন : ১৬)।
৩. তওবা ও ইস্তেগফারের সঙ্গেও এ নেয়ামতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কেননা মানুষ ঈমান এনে, আমল করে এবং ও এসবের ওপর অবিচল থেকেও কখনও কখনও গোনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। অতএব ওইসব গোনাহের প্রায়শ্চিত্তে মানুষকে সব সময় আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা ও ইস্তেগফার করা জরুরি। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ করো; তিনি আসমান থেকে তোমাদের ওপর বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন।’ (সূরা হুদ : ৫২)। তিনি আরও বলেন, ‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন।’ (সূরা নুহ : ১০-১১)।
৪. সর্বশেষ এ নেয়ামত আল্লাহর প্রতি আমাদের শোকর ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তায়ালা কতই না সুন্দর বলেছেন, ‘তোমরা যে পানি পান করো, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন না, আমি বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছা করলে তাকে লোনা করে দিতে পারি, অতঃপর তোমরা কেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো না?’ (সূরা আল ওয়াকিয়া : ৬৮-৭০)। তাছাড়া নেয়ামত ভোগ করে যদি কৃতজ্ঞতা আদায় না করা হয়, তবে সে নেয়ামত ছিনিয়েও নেয়া হতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সূরা ইবরাহিম : ৭)।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর