শ্রদ্ধা-ভালবাসায় নিহতদের স্মরণ, জঙ্গি নির্মূলের প্রত্যয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  রাজধানীর গুলশানে রক্তস্নাত সেই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় শোকাতুর স্মরণ করেছেন সর্বস্তরের মানুষ। নারকীয় ওই হামলার এক বছর পূর্তিতে শনিবার সকালে সেখানে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে এ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। এসময় জঙ্গিবাদ নির্মূলের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।

অপরদিকে বাংলাদেশে নজিরবিহীন এই হামলার ঠিক এক বছর পর শনিবার হামলাকারী পাঁচ জঙ্গির ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। এতে বলা হয়, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী জঙ্গিরা গুলি ও বোমায় নিহত হয়।

হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার এক বছর পূর্তিতে সেখানে জঙ্গিদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়া দেশি-বিদেশিদের গভীর শ্রদ্ধা ও শোকাতুর পরিবেশে স্মরণ করা হয়। শনিবার সকাল থেকে গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের এ রেস্তোঁরায় নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, নিহতদের পরিবারের স্বজনসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা সবার জন্য হলিজান আর্টিজান রেস্তোঁরার ফটক উন্মুক্ত রাখা হয়।

সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার। সেই জায়গাটিতে হলি আর্টিজানের ঘটনা বড় আঘাত। আমরা কখনই ভাবিনি এ রকম একটি ঘটনা ঘটতে পারে। জাতি এ জন্য প্রস্তত ছিল না।

হলি আর্টিজান রেস্তোঁরায় হামলায় নিহত ইশরাত আখন্দের মামা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই দিনটি আমাদের জন্য কত বেদনার। শুধু নিকটাত্মীয়কে হারিয়েছি বলেই নয়, আমাদের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের মধ্যে একটা কলঙ্কের তিলক যুক্ত করায়ও। আমি এখানে নিহত সবার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি।

শ্রদ্ধা জানানোর পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সফল। কিন্তু জঙ্গি নির্মূলে আদর্শিক লড়াই চালাতে হবে। শক্তি দিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয়। সাময়িকভাবে সম্ভব হলেও জামায়াত-শিবির, মওদুদীবাদী, ওয়াহাবিবাদী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এরাই আসলে মানুষকে ধর্মের বিষয়ে ভুল বার্তা দিচ্ছে।সকাল ৮টার কিছু পরে প্রথমে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জাপানের রাষ্ট্রদূত মাশাতো ওয়ানাতাবে ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি মিকিও হাতাডেয়া। অস্থায়ী শ্রদ্ধাস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে অল্প সময় নিয়ে হলি আর্টিজান ত্যাগ করেন তারা।এছাড়া জঙ্গি হামলায় নিহতদের শোকাতুর স্মরণ করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অপারেশনস) মোখলেসুর রহমান, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া প্রমুখ।অন্যদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী হোলি আর্টিজান বেকারিতে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, ঘটনাটি হৃদয়বিদারক। উগ্রবাদীদের হাত আছে এখানে। প্রগতির ক্ষেত্রে এটি একটি কলঙ্কজনক তিলক। সারাদেশে উগ্রবাদীদের নেটওয়ার্ক চেপে বসেছে। এটি নস্যাৎ করতে সরকারের সামগ্রিক ও সমষ্টিগত পদক্ষেপ প্রয়োজন।আর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা আজ ব্যথিত, মর্মাহত ও একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ। ধর্মের নামে সেদিন মানুষ হত্যা করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের অপশক্তিকে মোকাবিলায় জনতা ও রাজনীতির এক সম্মিলিত রাজনৈতিক ঐক্য দরকার।

হলি আর্টিজানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চট্টগ্রাম থেকে গুলশানে আসেন ওই দিনের হামলায় প্রাণ হারানো ইশরাত আখন্দের বন্ধু ফারহানা আনন্দময়ী। তিনি বলেন, হামলার খবর সারারাতই টিভিতে দেখেছি। তখনও জানতে পারিনি যে জঙ্গিদের হামলায় ইশরাত প্রাণ হারিয়েছে। পরদিন সকালে জানতে পারলাম, ইশরাত আর নেই। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম সবসময়। একটা বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও কোনোভাবেই ভুলতে পারিনি ইশরাতকে। ফারহানার মতো শত মানুষের ঢল ছিল সেই হলি আর্টিজানে। এক বছর আগের এই দিনে এই রেস্টুরেন্টে জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ২০ জন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেয়া হয় তখনকার রেস্টুরেন্টটি।এদিকে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনাকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ মনে করে পুলিশ। শনিবার সকালে গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার এক বছর উপলক্ষে জঙ্গিদের হাতে নিহত সহকর্মী ও দেশি-বিদেশিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে এ মন্তব্য করেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান।তিনি বলেন, এ ঘটনার যে ব্যাপকতা তার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না। সেই অবস্থায় এদেরকে মোকাবিলা করা তাত্ক্ষণিকভাবে আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা নিজেদের সীমিত সাধ্যে মধ্যে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, দুজন কর্মকর্তাকে হারিয়ে, আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি।

অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ যাতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিভাত হতে না পারে তার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। জঙ্গিবাদ ঠেকাতে বাংলাদেশ পুলিশ যে সফল হয়েছে, অন্যান্য বাহিনী যে সফল হয়েছে, সেটা পৃথিবীর সব নিরাপত্তা বাহিনী ও সংস্থা একবাক্যে স্বীকার করছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আমরা সুফল পাচ্ছি, দেশ তার সুফল পাচ্ছে। মানুষ এখন স্বস্তি ও শান্তির মধ্যে আছে দাবি করে তিনি বলেন, আমরা মনে করি, অতীতে যেভাবে এগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি, ভবিষ্যতেও তাদের নির্মূল করতে সক্ষম হব।গুলশান হামলার ঘটনায় জড়িত পলাতক কয়েক জঙ্গিকে আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে গ্রেফতার করা সম্ভব হতে পারে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। শনিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন তিনি।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, হলি আর্টিজান হামলার সঙ্গে পলাতক জঙ্গিদের কানেকশন ইতোমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানা গেছে। এখন তাদের সম্ভাব্য আস্তানা ও অবস্থানের তথ্য নিশ্চিত হতে পারলেই গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।অতিরিক্ত ডিএমপি কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবি নেতা আইয়ুব বাচ্চুকে ধরতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি টিম নাটোর যাওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে কুষ্টিয়ার তথ্য পেয়ে সেখানে অভিযান চালিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রীসহ আরও কয়েকজনকে পাওয়া গেছে। এটা ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেছে। কাজেই যেকোনও ওয়ান্টেড জঙ্গিরাও গ্রেফতার হতে পারে।

তিনি বলেন, পলাতক আসামিরা হচ্ছে-সোহেল মাহফুজ, বাশারুল ওরফে চকলেট, রাশেদুল ইসলাম র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর ও ছোট মিজান।উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নজিরবিহীন ও ন্যাক্কারজনক এ জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ১ জুলাই। সেদিন রাত পৌনে ৯টার দিকে রাজধানীর গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের এ রেস্তোরাঁয় পাঁচজনের একটি সশস্ত্র জঙ্গিদল অতর্কিত হামলা চালায়। ঘটনার শুরুতেই জঙ্গিদের সঙ্গে গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার তত্কালীন ওসি সালাউদ্দিন খান নিহত হন। পরে রেস্তোরাঁয় থাকা ২০ জন বিদেশি নাগরিকসহ ৩০-৩৫ জনকে জিম্মি করে রাখে ও রাতভর হত্যাযজ্ঞ চালায়।পরের দিন সকালে রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী। অভিযান শেষে যৌথ বাহিনী বিদেশি নাগরিকসহ মোট ১৩ জনকে জীবিত এবং মোট ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। নিহত ২০ জনের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর