মধ্যরাত থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে ছিটমহল

শুক্রবার মধ্যরাত থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে ছিটমহল। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন ৫৪ হাজার ছিটমহলবাসী। বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডে বিলীন হচ্ছে ১৬২টি ছিটমহল। ছিটমহলবাসীও খুঁজে পাচ্ছেন তাদের স্থায়ী ঠিকানা। তারা ৬৮ বছরের বঞ্চনা মুছে ফেলবেন নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে। ঢাক-ঢোলের সঙ্গে উৎসবে মেতে উঠবেন একসঙ্গে। সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ আজ মধ্যরাত।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে মধ্যরাত থেকেই এসব ছিটমহল নামের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হচ্ছে। দু’দেশের দীর্ঘদিনের বহুল বিরোধপূর্ণ সীমান্ত সমস্যার অবসান ঘটবে এই মধ্যরাতেই। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে মিশে যাবে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। আর ভারতের মূল ভূখণ্ডে মিশে যাবে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ছিটমহলগুলোতে মধ্যরাত থেকেই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হবে। এর ফলে দু’দেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমানা চুক্তির (এলবিএ) বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৩১ জুলাই মধ্যরাতেই দু’দেশের মধ্যে ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতীয় ১১১ ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। একইসঙ্গে ভারতের ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। উভয় দেশের মধ্যে কয়েক হাজার একর অপদখলীয় জমিও হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
এদিকে বাংলাদেশে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত জমি সংযুক্ত করে এবং বহির্ভূত জমি বাদ দিয়ে একটি গেজেট নোটিফিকেশন জারি করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকার অপশন প্রদানকারীরা ছাড়া অন্যরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাবেন। আর ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আজ মধ্যরাত থেকে ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হচ্ছে। উভয় দেশের সরকার ছিটমহলবাসীদের নাগরিক দেশ পরিবর্তনের সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে ইচ্ছুকরা স্থান পরিবর্তন করতে পারবেন। এছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় জমি ও অচিহ্নিত সীমানার ৩০টি স্ট্রিট ম্যাপে সই করেছেন দু’দেশের হাইকমিশনার।
জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে ভূমি জরিপ অধিদফতরে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন এগুলোতে সই করেন।
আমাদের নীলফামারী প্রতিনিধি নুর আলমের কাছে ছিটমহলবাসী তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘হামরা এখন বাংলাদেশি। আগোত হামার বিচার সালিশ করিবার কাহো আছিল না, এ্যালা বাংলাদ্যাশের মাইনষি (মানুষ) হইনো, দ্যাশের আইনও পাইনো। এলানি আইতোত (রাতে) একেনা শান্তিত ঘুমিবার পারিমো বাহে।’
এদিকে ছিটমহল নামের যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটলেও এসব মানুষের মাঝে জমির মালিকানা নিয়ে বিরাজ করছে নানা শঙ্কা। প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এসব ছিটমহলে গড়ে ওঠেনি জমি বেচা-কেনায় রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা। ফলে এসব জমি-জমা যত হাত বদল হয়েছে, তা হয়েছে মৌখিক, সাদা কাগজে অথবা বাংলাদেশের স্ট্যাম্পে লিখিত করে। যা প্রচলিত আইনে জমির মালিকানা হস্তান্তরে কোনো বৈধতা নেই।
পঞ্চগড় থেকে আমাদের প্রতিনিধি আনিস প্রধান জানান, পঞ্চগড় জেলার ৩৬টি ভারতীয় ছিটমহল বিনিময় হবে মধ্যরাতে। ছিটমহল বিনিময়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রশাসন ও ছিটমহলবাসী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে দিনে খেলাধুলা, প্রতিপাদ্য নাটক, রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মশাল প্রজ্বলন ও প্রতিটি বাড়িতে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হবে। উৎসব উপলক্ষে আজ দুপুরে বিশেষ মোনাজাত, প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ছিটমহলগুলোতে শুরু হবে আনুষ্ঠানিকতা। দিনভর চলবে নৌকা বাইচ, ঘোড়-দৌড়, লাঠি খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পোড়ানো হবে আতশবাজি, ওড়ানো হবে ফানুস।
কোচবিহার থেকে আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি সংলাপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় পরিচয় পাওয়ার আনন্দের মধ্যেও শঙ্কায় ৫১টি ছিটমহলের শিক্ষার্থীরা। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েও বিষাদের ছায়া ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি ছিটমহলের প্রায় শতাধিক পড়–য়ার মনে। কারণ স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটে এবং রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্রে পিতৃপরিচয় ভিন্ন। পড়াশোনার তাগিদেই নিকট আত্মীয়দের পিতৃ পরিচয় দিয়ে ভর্তি হয়েছিল কোচবিহার জেলার বিভিন্ন স্কুলে।
তবে ৩১ জুলাই মাঝরাতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলগুলোর আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরকে কেন্দ করে ইতিমধ্যেই উৎসবের চেহারা নিয়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা ছিটমহলগুলোতে। চুলে ও হাতে রঙিন মেহেন্দি পরছে মেয়ে ও বউরা। ছিটমহলের তরুণী সালেমা বলেন, বাবা-মা জন্ম দিলেও এতদিন বিশ্বকে বলতে পারিনি। কিন্তু ৩১ তারিখের মধ্যরাতের পর থেকে পিতৃ পরিচয় দিতে পারব বিশ্বকে। শুক্রবার রাত আটটা থেকেই মধ্য মশালডাঙা ছিটে ছিটমহলবাসী নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসবেন। বৈঠক শেষে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে। এরপর খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ছিটমহল আলোকমালায় ঝলসে উঠবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। তবে রাষ্ট্রপতি কালামের মৃত্যুতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর