জমির মালিকানা ঘিরে শঙ্কা

বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তির আওতায় ছিটমহল বিনিময়ের মাহেন্দ্রক্ষণে কাটেনি শঙ্কার মেঘ। বেশির ভাগ ছিটমহলবাসীর মধ্যে বিরাজ করছে জমি নিয়ে সংঘর্ষের আশঙ্কা। জমির দখল, মালিকানা, রেজিস্ট্রিসহ জটিল নানা বিষয় নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। এসব ছিটমহলে রেজিস্ট্রি ছাড়াই জমির কেনাবেচা চলেছে দীর্ঘদিন। ফলে মালিকানা নিয়ে রয়েছে আইনগত সমস্যা। সে ক্ষেত্রে ছিটমহল বিনিময়-পরবর্তী এসব জমি নিয়ে কী ঘটবে, তা নিয়ে কাটছে না উদ্বেগ। ইতিমধ্যে বেচাকেনা করা জমির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা স্পষ্ট নয় বাসিন্দাদের কাছে। এ অবস্থায় জটিলতা নিরসনে সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রত্যাশা করছে ছিটমহলবাসী।

সরেজমিন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে গিয়ে দেখা গেছে, বাসিন্দাদের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে জমি নিয়ে জটিলতা। বেশ কয়েকটি পরিবারে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অনেকের দখলে দীর্ঘদিন জমি থাকলেও নেই নামজারিসহ রেজিস্ট্রেশন। সাদা কাগজ অথবা ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে হয়েছে জমি বিক্রির চুক্তি। এসব ঘটনার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কী হবে, তা বুঝতে পারছে না বাসিন্দারা।

দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের ছোট কামাত গ্রামের হানিফ আলী জানান, চাচা হাসমত আলীর কাছে থেকে তিন ভাই মিলে এক বিঘা জমি কিনে ২২ বছর ভোগদখল করছিলেন। কিন্তু রেজিস্ট্রি হয়নি। কয়েক দিন আগে চাচা জমি বিক্রির কথা অস্বীকার করেছেন। এ নিয়ে বিরোধ চলছে। একই গ্রামের বানিয়াটারীর মনছার আলী জানান, জ্যাঠাতো ভাইয়ের কাছে থেকে চার শতক জমি কিনলেও রেজিস্ট্রি হয়নি। এখন বিক্রির কথা স্বীকার করছেন না। ভূমি জরিপের সময় এ জমি তিনি নিজের বলে দাবি করবেন বলে ধারণা। ছিটমহলের অনেক পরিবারেই প্রায় অভিন্ন এ সংকটের কথা জানা গেছে।

জমির মালিকানা ঘিরে শঙ্কা

বাসিন্দারা জানায়, এক হাজার ৬৪৩ একর জমির ভারতীয় ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার বাসিন্দারা একসময় ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটায় গিয়ে গোপনে জমি রেজিস্ট্রির কাজ করত। এক দশকের বেশি সময় ধরে সে কাজ বন্ধ। ফলে পরবর্তী সময় জমি কেনাবেচা হয়েছে ১৫০ টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্পে চুক্তি করে। এসব জমির মালিকরা এখন দলিল ছাড়া কিভাবে নামজারি করে জমি ভোগদখল করবে, তা নিয়ে চিন্তিত।

ছিটমহলের বাসিন্দা ধনেশ চন্দ্র কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিন বছর আগে ১০ হাজার টাকা শতক দরে ৪০ শতক জমি কিনেছি ছিটের বাসিন্দা সেকেন্দারের কাছ থেকে। রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। স্ট্যাম্পের ওপর লেখা আছে। এখন এই জমির কী হবে, এ নিয়ে চিন্তায় আছি।’

ছিটের বাসিন্দা হাসান আলী ও নছিয়ত উদ্দিন জানান, ছিটের ভেতরে ও বাইরের অনেকেই জাল স্ট্যাম্প করে জমি কিনে ফ্যাসাদ করার তালে আছে। সরকার এ ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ না নিলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে।

ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন জানান, বাংলাদেশের নিবন্ধন ছিল না। তাই রেজিস্ট্রি হয়নি। তবে স্ট্যাম্প বা স্থানীয় দলিলকে জরিপের সময় বিবেচনায় নিতে হবে। বিরোধ হলে গণশুনানি হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১১১টি ছিটমহলের ৫৯টির অবস্থান লালমনিরহাটের তিনটি উপজেলায়। এসব জমির সঠিক পরিমাণ জানা না গেলেও এগুলো রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার বিভিন্ন ভূমি অফিসের আওতায়। অনেক জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল দেশটির দিনহাটা, শিতলকুচিসহ অন্য এলাকার কোনো না কোনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। ফলে ভারতে রেজিস্ট্রি করা এসব দলিলই এখন একমাত্র প্রমাণপত্র।

লালমনিরহাটের ভেতরে থাকা বিভিন্ন ছিটমহল ঘুরে জানা গেছে, ৯ জুলাই বুড়িমারী স্থলবন্দরে অনুষ্ঠিত উভয় দেশের এক যৌথ বৈঠকের পর ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন অফিসে থাকা পুরনো জমির রেকর্ড খোঁজার সিদ্ধান্ত হলেও এখন পর্যন্ত ছিটমহলবাসীদের জমির মালিকানা নির্ধারণ, কাগজ পরিবর্তন বা নতুন করে জরিপের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

পাটগ্রামের ভেতরে থাকা ভোটবাড়ী ছিটমহলের হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলীগঞ্জ থানার আওতায় থাকা ছিটমহলবাসী ছিলাম। এখানকার জমিগুলো সেখানকার অফিসের আওতায় রয়েছে। তবে ছিটমহল বিনিময়ের পর আমরা বাংলাদেশেই থেকে যাব। সে ক্ষেত্রে জমির মালিকানা পরিবর্তন নিয়ে আমরা রয়েছি দুশ্চিন্তায়।’ একই ছিটমহলের বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘জমিগুলো যাদের নামে রেকর্ড করা আছে, সেসব মালিকের কাছে এখন সেই জমি নেই। হয়তো কেনাবেচা হয়ে এর মালিক হয়েছে অন্য কেউ।’ বাঁশকাটার উকিল চন্দ্র বলেন, ‘সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে আমরা ভারতে গিয়ে জমি রেজিস্ট্রির মাধ্যমে কেনাবেচা করতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে স্ট্যাম্পে বা সাদা কাগজে নিজেরাই লেখালেখি করে জমি কেনাবেচা করে আসছি এত দিন ধরে।’

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বেহুলাডাঙ্গা ছিটমহলের আহসান উল্লাহ চানু, ঈমান আলী ও হাবিবুর রহমান কয়েক মাস আগে ছিটমহল নাগরিক কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, তাঁদের প্রায় ১০ বিঘা জমি ক্রয়ের কথা বলে কয়েক বছর আগে থেকে জবর দখল করে রেখেছেন একই ছিটমহলের হাসমত আলী, তোজাম্মেল হক ও কামাল। অভিযোগ পেয়ে বাদাম চাষ করা ওই জমিতে ছিটমহল নাগরিক কমিটি লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়ে উভয় পক্ষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে বাদাম তুলে অর্ধেক বর্গাচাষিদের ও অর্ধেক কমিটি নিজেদের কাছে জমা রেখেছে। ঈমান আলীদের অভিযোগ, কেনার কথা বলে কোনো টাকা না দিয়ে ও রেজিস্ট্রি না নিয়েই গায়ের জোড়ে জমি দখল করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, জমির এই ভেজাল অনেক আগের। কমিটি টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রির রায় দিলেও হাসমত আলীরা তা মানেননি। এ জন্য বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত আছে।

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার সভাপতি মফিজার রহমান বলেছেন, জমির মালিকানা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছুই নেই। যার যার দখল ও ছিটমহলের দলিল আছে

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর