কর্ণফুলীর তীরে শুঁটকিপল্লী

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম শুঁটকিপল্লী। নদীর উত্তর-দক্ষিণ তীরঘেঁষে বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গাচর, কর্ণফুলী ঘাট ও জুলধায় গড়ে উঠেছে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ। প্রতি মৌসুমে এখানে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কয়েক হাজার নিু আয়ের মানুষের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা হয় এখান থেকে। সাগরের কুতুবদিয়া, কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকার গভীর সমুদ্র থেকে জেলেদের সংগ্রহ করা মাছ কর্ণফুলীর তীরে আনা হয়। স্বস্তা শ্রমিক ও নৌপথে সহজ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে কর্ণফুলীর তীরে গড়ে ওঠে এ শুঁটকিপল্লী। সম্প্রতি বাকলিয়াসহ আশপাশের কয়েকটি শুঁটকিপল্লী সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ছুরি, হাঙ্গর, চিংড়ি, পোপা, লইট্ট্যা, ফাইশ্যা, বাইল্যা, হঁস, চাঁদা বাইল্যা, ফটকা, টিক্কা, টাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মাচাংয়ে বেঁধে রোদে শুকানো হচ্ছে। শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি লাক্কা ও রূপচাঁদা সারিবদ্ধভাবে শুকাতে দেখা গেছে। তবে বাকলিয়ার শুঁটকিপল্লীতে নারী ও শিশু শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা বেতনবৈষ্যম্যের শিকার। রুবি আকতার ও ছখিনা বেগম নামে দুই নারী শ্রমিক অভিযোগ করে বলেন, ‘দিনভর পরিশ্রম করে আমরা পাই মাত্র ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। পুরুষ শ্রমিক প্রায় দ্বিগুণ টাকা পায়। অথচ তাদের চেয়ে আমরা বেশি কাজ করি।’ জানা যায়, বাকলিয়ার কর্ণফুলীর তীরে (সেতুসংলগ্ন এলাকা) ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের আগে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরির কাজ শুরু করেন। এর পর থেকেই বর্তমানে শতাধিক মাচাংয়ে শুঁটকি তৈরি চলছে। প্রতি সপ্তাহে শতাধিক টন শুঁটকি নগরীর পাইকারি বাজার আছাদগঞ্জে সরবরাহ করা হয়। অবশ্য কর্ণফুলীর তীরবর্তী হওয়ায় এখানে শুঁটকি তৈরিতে খরচ কম পড়ে। নদী ও সাগর থেকে মাছ আহরণ করে সহজ পথে এখানে আনা যায়। বাঁশখালী উপজেলার নদীপাড়ের বাসিন্দা আবদুর রহিম ৩০ বছরের যুবক। সেই ’৯১-এর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পানিতে ভেসে যায় তার বাড়িঘর। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে জীবিকার তাগিদে চলে আসেন চট্টগ্রামের বাকলিয়ায়। এর পর থেকেই শুঁটকিশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। রহিম জানান, ‘খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী লোকমান নামের এক নিকটাত্মীয়ের হাত ধরেই বাকলিয়ার শুঁটকিপল্লীতে কাজ শুরু করি। দীর্ঘদিন ধরেই শুঁটকিপল্লীতে কাজ করার সুবাদে পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন যাপন করছি।’ বাকলিয়ার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ব্যবসায়ী নেতা জামাল হোসেন বলেন, ‘৯১ সালে ১০-১৫ জন ব্যবসায়ী বাকলিয়া শুঁটকিপল্লীতে শুঁটকি তৈরির কাজ শুরু করেন। বর্তমানে শতাধিকের উপরে মাচাং গড়ে উঠেছে। জানা যায়, বাজার থেকে কাঁচা ছুরি মাছ কিনতে হয় কেজি ২০ থেকে ৫০ টাকা দরে। তা শুকিয়ে শুঁটকি করে বিক্রি করা হয় ২০০ থেকে ১২০০ টাকা দরে। একইভাবে হাঙর মাছ কেনা পড়ে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। এটি শুঁটকি করে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৮০০ টাকায়। লইট্টা মাছ কেনা হয় ৫০ থেকে ৭০ টাকায়। তা শুকিয়ে বিক্রি করা হয় ২৩০ থেকে ৪৫০ টাকায়। পোপা মাছ কেনা হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। শুকিয়ে বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। এ ছাড়াও শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে লাক্কা ও রূপচাঁদা। ১ কেজি রূপচাঁদা শুঁটকি ২০০০ থেকে ৩০০০ ও লাক্কা ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সাগরপাড়ে শুকানো শুঁটকির স্বাদ ভালো হয়। তাই সাগরের শুকানো মাছগুলোর দাম বেশি। এ মাছগুলো লোনা পানির। লোনা ও বাতাসে শুকানো শুঁটকির স্বাদ-গন্ধ আলাদা। আর কর্ণফুলীপাড়ে মাছে লবণ মিশিয়ে শুকাতে হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, নগরীর মাছের বড় আড়ত ফিশারিঘাট ও বোট মালিক-মাঝিদের থেকে কাঁচা মাছ কিনে শুঁটকি বানানো হয়। বর্তমানে শতাধিক মাচাং থেকে প্রতি বাজার দিনে (শনি ও মঙ্গলবার) অন্তত ১০০ টন শুঁটকি পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়। এখানকার শুঁটকি ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। দাদনের ওপর নির্ভর করতে হয়। মৌসুম শুরুর আগে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে হয় তাদের। শুঁটকিও দিতে হয় দাদন নেওয়া ওই ব্যবসায়ীদের। বোয়ালখালীর জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যবসায়ী জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন মাচাং বানানো হয়েছে। এক বছর মেয়াদি জায়গাগুলোর ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। জমির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়।

<a

href=’http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=a35ce767′
target=’_blank’><img
src=’http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/avw.php?zoneid=782&amp;n=a35ce767′
border=’0′ alt=” /></a>

তিনি বলেন, ‘এসব জায়গা হচ্ছে সরকারি খাস জায়গা। স্থানীয় সন্ত্রাসীরা অবৈধভাবে দখল করে এসব জায়গা ভাড়া দেয়। তাদের কিছু বলারও সুযোগ নেই। ভাদ্র থেকে শুঁটকির মৌসুম শুরু হয়ে ছয়-সাত মাস মৌসুম থাকে। এরপর বর্ষা শুরু হলে আর মাছ শুকানো যায় না। তবে বর্ষাকালে মাছ শুকানো বন্ধ থাকলেও জায়গার ভাড়া গুনতে হয় আমাদের।’ আছাদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ মুছা সওদাগর বলেন, ‘চট্টগ্রামের বাকলিয়ার কর্ণফুলী ও পটিয়ার নদীর পাড়ে শুঁটকি শুকানো হয়। তবে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, বাঁশখালী ও রাঙাবালির চরের (সুন্দরবন এলাকা) শুঁটকি উন্নতমানের। এখানকার (বাকলিয়া ও পটিয়া) শুঁটকিও খারাপ নয়। বিক্রেতারা তো নিুমানের শুঁটকি বিক্রি করতে চান না। এতে ব্যবসার সুনাম নষ্ট হয়ে যাবে।’আছাদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমদ (সাহেব মিয়া) বলেন, ‘বাজারবারে (শনি ও মঙ্গলবার) বাকলিয়া শুঁটকিপল্লী থেকে শতাধিক মেট্রিক টন শুঁটকি বাজারে আসে। সাগরপাড়ে শুকানো শুঁটকি ও নদীর পাড়ে শুকানো শুঁটকির মধ্যে স্বাদ, গন্ধ ও সুন্দরে তফাত রয়েছে। বর্তমানে ব্যবসায়িক মন্দাভাব চলছে। এখন শনি ও মঙ্গলবারে মাছ আসে মাত্র অর্ধ মেট্রিক টন। ব্যবসায়ীরা এখন বসে বসে পুঁজি খাচ্ছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর