প্রকৃতির অগ্নিরূপ, পুড়ছে যশোরাঞ্চল

প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়ছে যশোর অঞ্চল। মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে নাকাল খেটে খাওয়া মানুষ। তীব্র গরমে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা। জরুরি কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের সর্তক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের মধ্যে আজ যশোরে সবচেয়ে বেশি গরম পড়ছে। তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকালও একই অবস্থা ছিল।৩-৪ দিন ধরে চলা এ তাপদাহে পুড়ছে প্রকৃতি। সঙ্গে যোগ হয়েছে আর্দ্রতা। সকালের দিকে আর্দ্রতা ৯০ শতাংশের ওপরে থাকছে। ফলে ঘেমে-নেয়ে একাকার হচ্ছে মানুষ। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি হলেও আসলে অনুভূত হচ্ছে ৪৬ ডিগ্রির মতো গরম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য আর্দ্রতা কমে আসছে।
আবহাওয়া অফিসের মতে, যশোরসহ খুলনা বিভাগের পাঁচ জেলায় মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। খাঁ খাঁ রোদে পুড়ছে গোটা অঞ্চল।
আজ সকাল থেকেই সূর্য যেন আগুন ঝরাতে থাকে।মাঝদুপুরে প্রকৃতি নেয় অগ্নিরূপ। ভ্যাপসা গরমে একটু প্রশান্তির আশায় কেউ কেউ ভিড় জমাচ্ছেন সরবতের দোকানে। কাঠফাটা রোদে চিল-চাতকের মতো হাঁসফাঁসে ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে জনজীবন।
ফলে দিনের বেলা রাস্তাঘাট একপ্রকার ফাঁকা। একান্ত দরকার ছাড়া মানুষ রাস্তায় নামছেন না। যানবাহনের সংখ্যাও কম। গন্তব্যে পৌঁছুতে মানুষকে বেগ পেতে হচ্ছে। রিকশাসহ অন্যান্য ছোটখাট যানবাহন নিয়ে যারা রাস্তায় নামছেন, তারা অসহনীয় কষ্ট পাচ্ছেন।
রিকশার সামনে ছাতা বেঁধে রাস্তায় নেমেছিলেন ৫৫ বছরের আব্দুস সামাদ। তিনি জানালেন, গত কয়েকদিন ধরে রোদে পুড়ে অসুস্থ বোধ হচ্ছিল। কিন্তু বাড়ি বসে থাকলে খাবার জুটবে না।তাই বাধ্য হয়ে রিকশার সামনে ছাতা বেঁধে রাস্তায় নেমেছি। তারপরও তাপ থেকে রক্ষা পাচ্ছিনে। রাস্তার গরম শরীরে এসে লাগছে।
তিনি বলেন, ‘আজ বোধ হয় কামাই ভালো হবে না। রোদের তাপ বাড়তে থাকলে বাড়ি চলে যেতে হবে।’
শাজাহান আলী নামে আরেক রিকশাচালক যশোর শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মোড়ের গাছের ছায়ায় নিজ রিকশায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এতো গরম যে মাঝে মাঝে মনে হয় নিশ্বাসও নিতে পারবো না। তাই এখানে বিশ্রাম নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘একটি ভাড়া খাটার পর আধাঘণ্টা বিশ্রাম না নিলে আরেকটি ভাড়া মারা যাচ্ছে না। এ কারণে রোজগার কমে গেছে।’
গরমের তীব্রতায় প্রশান্তি পেতে রাস্তার ধারের দোকানে সরবত পান করছিলেন শাহরিয়ার নামে এক যুবক। তিনি বলেন, ‘গরমে ফ্যানের বাতাসও গায় লাগে না। আবার কিছু সময় বিদ্যুৎ ছিল না। তাই সরবত খেতে এসেছি।’
‘গত তিন-চারদিন ধরে গরমে নাকাল হয়ে গেছি। আর দিনে রাতে একাধিকবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় কষ্ট আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে বাড়িতে শিশুদের কষ্ট দেখার মতো নয়,’ বলছিলেন শাহরিয়ার।
আইনজীবী বোরহান উদ্দিন জাকির বলেন, ‘গরমে জীবন এখন ওষ্ঠাগত। খাল, বিল, পুকুর, নদী ভরাট ও গাছ কাটার ফল ভোগ করছি আমরা। আমাদের থেকে খেটে খাওয়া মানুষের ভোগান্তি আরো বেশি। প্রচণ্ড তাপদাহে তারা কাজ করতে গিয়ে ঘামে গোসল করে ফেলছে। কাজে কামাই দেওয়ারও উপায় নেই তাদের। একটু বৃষ্টি হলে পরিত্রাণ মিলতো বোধ হয়।’
স্কুল শেষে পাশের পুকুরে জলকেলি করতে দেখা যায় জিলা স্কুলের একদল ছাত্রকে। এদের মধ্যে রায়হান নামে এক ছাত্র জানালো, ক্লাস শেষে রোদের ভিতর মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করে গরমে কাহিল হয়ে পড়েছে। তাই সবাই মিলে পুকুরে গোসল করতে নেমেছে তারা। এখন একটু শান্তি লাগছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গরমে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখিন হয় শিশুরা। ফলে তাদের ব্যাপারে বেশি সচেতন থাকার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
যশোর শিক্ষা স্বাস্থ্য ক্লিনিকের মেডিকেল অফিসার ডা. প্রতিভা ঘরাই বলেন, ‘প্রচণ্ড তাপদাহে বাচ্চারাসহ বড়রাও অসুস্থ হচ্ছে। এ গরমের কারণে তারা পানি শূন্যতা, আমাশয়, ডায়রিয়া, জন্ডিস ও হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি, লবণ-পানির সরবত বা ডাবের পানি খেতে হবে।’
‘তবে যারা মনে করেন ঘামের কারণে খাবার স্যালাইন খেলে ভালো হবে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ খাবার স্যালাইনে থাকে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম। কিন্তু ঘামের কারণে শরীর থেকে কেবল সোডিয়াম বের হয়। ফলে অতিরিক্ত পটাসিয়াম শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এজন্য স্যালাইন না খেয়ে লবণ-পানির সরবত ও ডাবের পানি খাওয়া ভালো,’ ভাষ্য এই ডাক্তারের।
একই সঙ্গে তিনি, শিশু, বৃদ্ধসহ সকলকে বাসি খাবার, রাস্তার পাশের কড়া ভাজা পোড়া ও অপরিচ্ছন্ন খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি ঢিলেঢালা পোশাক পরা ও রোদের মধ্যে বের হতে হলে ছাতা নেওয়ার তাগিদ দেন। এতে করে গরমজনিত নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম হবে ডা. প্রতিভার অভিমত।
তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. প্রণবকুমার চৌধুরী ওরস্যালাইন পানের পরামর্শ দিয়েছেন। অনলাইনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীর থেকে লবণ চলে যাচ্ছে। তাই সব বয়সী মানুষের উচিত ওরস্যালাইন খাওয়া। সকাল নয়টা থেকে তিনটা পর্যন্ত ঘরের বাইরে গেলে ছাতা ব্যবহার করা।’
অধ্যাপক ড. চৌধুরী বলেন, ‘এখন শিশুদের মধ্যে হাম, ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।তাই অভিভাবকদের সাবধান হতে হবে। ঘামাচি ও সর্দিজ্বরের আশঙ্কাও রয়েছে।’
আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী দুই দিন স্বস্তির কোনো খবর নেই। অর্থাৎ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে কোথাও কোথাও আকাশ আংশিক মেঘলা থাকতে পারে। বৃষ্টি না হলে এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন পর্যন্ত তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর