লোডশেডিং কাকে বলে

বিভিন্ন সমস্যার কারণে চাহিদা মতো বিদ্যুত্ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে খোদ বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী সোমবার স্বীকার করলেও বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড ওইদিনের চিত্রে দাবি করেছে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে। সারাদেশের মানুষ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে হা-হুতাশ করলেও স্বীকার করছে না পিডিবি। তাহলে লোডশেডিং কাকে বলে? এর সংজ্ঞা কী? জানতে চাওয়া হয়েছিল পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লার কাছে। তিনি সকালের খবরকে জানান, লোডশেড অর্থ বাড়তি লোড কেটে দেওয়া। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে না পারা হল লোডশেডিং। সেটা হতে পারে উত্পাদন ঘাটতি, সঞ্চালন কিংবা বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে। তিনি বলেন, লোডশেডিং নিয়ে পিডিবি বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। আর এই চরম অন্যায় কাজ করতে সরকার তাদের বাধ্য করছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সকালের খবরকে বলেন, লোডশেডিং আগেও ছিল, এখনও আছে। এই সত্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। যারা বলছে লোডশেডিং নেই তারা মিথ্যা বলছে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন, বিদ্যুতের উত্পাদন ও চাহিদা নিয়ে আগে পরিষ্কার তথ্য দেওয়া হতো। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। তথ্যের গোঁজামিল রয়েছে। তিনি বলেন, অনেক জায়গায় সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা যায় না, এটা সত্য। এই সীমাবদ্ধতা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাতেও বর্তমানে ১ থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের তথ্য লুকানো হচ্ছে। তাছাড়া এখন তো ঝড়, বৃষ্টি নেই যে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাবে। তাহলে বিদ্যুত্ সঞ্চালনে সমস্যা কোথায়? তার ধারণা, গ্যাসের অভাবে অনেক বিদ্যুেকন্দ্র চালানো হচ্ছে না। তেলভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র চালাতে গেলে খরচ অনেক বেশি। এখন হয়তো ওই তেলের টাকা জমিয়ে পরে এসব বিদ্যুেকন্দ্র চালু করে রমজানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তা না হলে সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বে। ইজাজ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের উত্পাদন অনেক বেড়েছে, এটা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার না করার কারণে মানুষের মনে অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। ফলে এত এত উত্পাদন-তবু এই পুরো জিনিসটাই অনেকের কাছে মিথ্যা মনে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রাম পর্যন্ত সবখানে গত কয়েক দিন ধরে তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাজধানীতে আগের চেয়ে লোডশেডিং বেড়েছে। গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল শহরে ১০ ঘণ্টা বা কোথাও কোথাও তার চেয়ে বেশি লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। বিদ্যুত্ সঙ্কটে সারাদেশের মানুষ যখন নাকাল, তখনও পিডিবির ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে লোডশেডিং শূন্য। বরং চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে-এমন তথ্যও সেখানে দেওয়া রয়েছে। পিডিবির ওয়েবসাইটে দেশের বিদ্যুত্ উত্পাদন সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায়, সোমবার সর্বোচ্চ চাহিদা ৯ হাজার ১শ’ মেগাওয়াটের বিপরীতে বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে ৯ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট। এর আগের দিন চাহিদা ছিল ৮ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট; উত্পাদনও ৮ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ২০ মে চাহিদা ছিল ৮ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট; উত্পাদন ৮ হাজার ৮১৯ মেগাওয়াট। ১৯ মে চাহিদা ছিল ৮ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট; উত্পাদন ছিল ৮ হাজার ৭৫৩ মেগাওয়াট। অর্থাত্ দেশের কোথাও কোনো লোডশেডিং নেই। সরকার গত বছর ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা উদযাপন করেছে। উন্নয়নের প্রসঙ্গ এলেই বিভিন্ন স্থানে সরকারের তরফ থেকে এটা বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে ৯ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। আসন্ন রমজানের শুরু থেকেই বিদ্যুত্ উত্পাদন ১১ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ঢাকা মহানগরী এলাকায় বিদ্যুত্ বিতরণ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। এই কোম্পানির চাহিদা প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট। তারা পাচ্ছে কমবেশি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঢাকার অন্য বিতরণ কোম্পানি ঢাকা বিদ্যুত্ বিতরণ কোম্পানির (ডেসকো) সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ৮৫০ মেগাওয়াট। কয়েক দিন ধরে তারা পাচ্ছে ৬০০ মেগাওয়াটের মতো। বর্তমানে মোট উত্পাদিত বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক চাহিদা রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। সর্বোচ্চ চাহিদা ৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে তারা পাচ্ছে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। রাজশাহীর নর্থ-ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির চাহিদা প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট। বিপরীতে তারা ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি পাচ্ছে না। বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের ২১টি জেলায় বিদ্যুত্ বিতরণ করে পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুত্ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। এই ২১ জেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে তারা ৯০০ মেগাওয়াটের মতো পাচ্ছে বলে কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে। সোমবার বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, টাওয়ার ভেঙে যাওয়া, ১০টি পাওয়ার প্ল্যান্ট রক্ষণাবেক্ষণে থাকায় ও গ্যাসের স্বল্পতার জন্য চাহিদা মতো বিদ্যুত্ দেওয়া যাচ্ছে না। চার দিনের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণে থাকা বিদ্যুেকন্দ্রগুলো উত্পাদনে আসবে। রমজানে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের প্রকল্পগুলো উত্পাদনে আসতে আরও ৩-৪ বছর সময় লাগবে। তার আগে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা চলছে ভালো পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর