বাংলার জামদানি শাড়ি সারাবিশ্বে

বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের লোকজ ও গৌরবময় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ জামদানি শাড়ি। এ শাড়ি দেশে-বিদেশে সমস্ত বাঙালি নারীর কাছে অতি প্রিয় শাড়ি। এ শাড়ি একদিকে যেমন রমণীদের কাছে প্রিয়, তেমনি এ শাড়ি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করাতে রয়েছে তার বিশাল ভূমিকা। এ শাড়ি এখন বিদেশে বাঙালি রমণীদের দেখাদেখি বিদেশিরাও ব্যবহার শুরু করেছে। দিন দিন বিদেশে এ শাড়ির চাহিদা বাড়ছে। রেশম, সুতা, জরি এবং শিল্পীর হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় তৈরি জামদানি শাড়ি প্রাচীনকালের মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে বাঙালি নারীদের অতি প্রিয়। বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ইতোমধ্যে নিবন্ধিত হয়েছে জামদানি। তবে জামদানি কারিগরদের অভিযোগ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঁচামাল ও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, দেশি কাপড়ের বাজার তৈরিতে সঙ্কট, নতুন প্রযুক্তির যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে সক্ষমতায় পেরে না ওঠা, বিপণন ব্যর্থতা, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের অভাব ও পুঁজি সঙ্কটে ধুঁকে ধুঁকে চলছে সম্ভাবনাময় এ পণ্যটি। অভিজ্ঞরা মনে করছেন জামদানি ও তাঁত শাড়ির ফ্যাশন ও ডিজাইনে বৈচিত্র্য এনে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। তাদের মতে, রফতানি ও বিক্রি বাড়াতে জামদানি শাড়ির দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা এবং ঐতিহ্যবাহী এ শাড়ির রঙ ও নকশার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে গবেষণা চালানো উচিত। সর্বজনস্বীকৃত জামদানির বহুমুখী ব্যবহার, আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম ও ঐতিহ্যের কারণে জনপ্রিয়তা ও চাহিদা অনেক বেড়েছে। রফতানি হচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালি। গুণগত মান, রঙ ও বাহারি ডিজাইনের কারণে বাংলাদেশি জামদানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালি নারীদের মধ্যে জামদানি শাড়ির প্রচলন বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আনাসহ এ পণ্য ভারতের সঙ্গে আমাদের আমদানি-রফতানি ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রফতানি ও বিক্রি বাড়াতে জামদানি শাড়ির দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা এবং ঐতিহ্যবাহী এ শাড়ির রঙ ও নকশার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে গবেষণা চালানো উচিত। জামদানি কার্পাস তুলা দিয়ে প্রস্তুত এক ধরনের সুবস্ত্র। প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের কাছে অতি পরিচিত। মসলিনের ওপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। ‘জামদানি’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। জাম অর্থ ফুল আর দানি হচ্ছে ধারক। এমনই এক সুন্দর অর্থ বহন করছে জামদানি শাড়ি। খ্রিস্টাব্দ তৃতীয় শতক থেকেই জামদানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া, পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’-রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশী’ কবিতার সদাগরি অফিসের কেরানি যুবকটির না পাওয়া প্রিয়ার পরনে যে ঢাকাই শাড়ি, তার জন্য আকুতি সব বঙ্গ ললনার। জামদানি মূলত ইতিহাসখ্যাত সেই ঢাকাই শাড়ি মসলিনেরই একটি প্রজাতি। জামদানি ঢাকা জেলার বিশেষ ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে জামদানি শিল্পের নাম। বাংলাদেশের অহঙ্কার হিসেবে চিহ্নিত এ শিল্পের ভেতরের যে ঐশ্বর্য ছড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্যে, তার ধারক হয়ে আজও জনপ্রিয়তায় অনন্য হয়ে আছে জামদানি বয়ন। মসলিনের পরিপূরক হয়ে ফ্যাশন ঐতিহ্যে বসতি গেড়েছিল যে জামদানি তা ক্রমেই বাংলার তাঁতিদের আপন মমতায় আর সুনিপুণ দক্ষতায় হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যের পাশাপাশি আভিজাত্যের পোশাক। গত বছর ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে জামদানি। বিসিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর (ডিপিডিটি) জামদানিকে এ নিবন্ধন দেয়। জামদানি এটি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পণ্য মসলিনের পঞ্চম সংস্করণ। একে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্যগত সুরক্ষার পথে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে গেল। তবে কষ্টের কথা হচ্ছে, জামদানির ইতিহাসও মসলিনের মতোই অস্বচ্ছ ও অস্পষ্ট। বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত এ শাড়ি সম্পর্কে বাঙালির ইতিহাস নীরব নিথর। জামদানির তথ্য জানার জন্য হাত পাততে হয় বিদেশি গবেষক ও পর্যটকদের বিচ্ছিন্ন বর্ণনা এবং স্থানীয়ভাবে শ্রুত কাহিনি, প্রবীণ তাঁতিদের ঝাপসা স্মৃতির কাছে। জামদানির নামকরণেও রয়েছে বিভিন্ন মতবাদ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকেও বঙ্গ থেকে সোনারগাঁ বন্দরের মাধ্যমে মসলিনের মতো সুবস্ত্র ইউরোপে রফতানি হতো। তবে মসলিন শব্দটির উত্পত্তি সম্ভবত ইরাকের মসুল শহর থেকে। আর জামদানি শব্দটি এসেছে পারস্য থেকে। ঢাকাই মসলিনের পরই ছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির সুনাম। পৃথিবীজুড়ে জামদানি শাড়ির গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনস্বীকৃত। এটি একান্তভাবে ঢাকার নিজস্ব কাঁচামালে তৈরি এবং ঢাকার তাঁত শিল্পীদের মৌলিক শিল্পবোধ এবং ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি। পৃথিবীর আর কোনো দেশের তাঁতিদের পক্ষে এ শাড়ি তৈরি সম্ভব হয়নি। এর কারণ পারিবারিক পরিমণ্ডলে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে শিল্পভুবন সৃষ্টি হয়েছে তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাছাড়া শীতলক্ষ্যার পানি থেকে তৈরি হওয়া বাষ্প সুতার প্রস্তুতি এবং কাপড় বোনার জন্য অনুকূল। প্রাচীনকাল থেকেই এ ধরনের কাপড় তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় বরাবর পুরাতন সোনারগাঁ অঞ্চলটিই ছিল ব্যাপক উত্পাদন কেন্দ্র। বর্তমানে রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ এবং সিদ্ধিরগঞ্জের প্রায় ১৫৫টি গ্রামে এই শিল্পের নিবাস। প্রাচীন সময়ে জামদানি বয়নে একমাত্র মুসলিম কারিগররাই ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। এখনও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকই এ শিল্পের দক্ষতার সঙ্গে জড়িত। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৪শ’ শতকে লেখা তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে সোনারগাঁয়ের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করতে গিয়ে মসলিন ও জামদানির কথা বলেছেন। জামদানি বিখ্যাত ছিল তার বিচিত্র নকশার কারণে। প্রতিটি নকশার ছিল ভিন্ন ভিন্ন নাম। পান্নাহাজার, বুটিদার, দুবলিজাল, তেরসা, ঝালর, ময়ূরপাখা, কলমিলতা, পুঁইলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, আঙুরলতা, প্রজাপতি, শাপলাফুল, জুঁইবুটি, চন্দ্রপাড়, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল-এমনই নানা রকম নাম ছিল এসব নকশার। ভিন্ন জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের বয়নশিল্প হিসেবে প্রাচ্যের বয়নশিল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল জামদানি মোটিফ। এ মোটিফে খুব সহজেই কাপড়ের ভেতর ছায়ার মাঝে তৈরি করা যায় নকশার প্রতিবিম্ব। জামদানি শাড়ির আগের সব বিখ্যাত ও অবিস্মরণীয় নকশা ও বুননের অনেকগুলোই বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। নবীন কারিগররা অধিকাংশ নকশাই বুনতে জানেন না। বর্তমান জামদানি শাড়ির পাড়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে করলা পাইড়, কনকা, করলা, ইঞ্চি ও মদন পাড়। শাড়ির শরীরে চলতি সময়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে সন্দেশ, জুঁই, ছিদার, গোলাপফুল ও চিরাবুটি নকশা। জামদানি তাঁতিরা সপ্তাহে ১৫০০ টাকা বা মাসে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। এতে করে তাদের সংসার চলছে না। বর্তমানে যে তাঁত রয়েছে সেগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। জামদানি শাড়ি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, ভারতীয় নকল শাড়ির কাছে ঢাকাই জামদানি শাড়ি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। কারণ, ইন্ডিয়ান জামদানি শাড়ি ক্রেতারা ঠিকভাবে চিনতে পারে না। আবার পলিয়েস্টার সুতা দিয়ে তৈরির কারণে দামেও সস্তা। যেখানে সিল্ক সুতা দিয়ে তৈরির কারণে ঢাকাই শাড়ির দাম বেশি পড়ে। এছাড়া পুঁজির অভাব, সুতার দাম বাড়তি, তাঁতিদের মজুরি কম হওয়াতে অনেকে এ শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। ফলে দিন দিন কমছে তাঁত। সরকার উদ্যোগ নিয়ে যদি ভারতীয় জামদানি শাড়িকে ঢাকায় আসা বন্ধ করার ব্যবস্থা করত তবে দেশের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাঁতিদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হলে জামদানি শিল্পীরা আবার পুনরুজ্জীবিত হবে। জামদানি শাড়ির ঐতিহ্য ফিরে আসবে। দেশ-বিদেশে জামদানি রফতানি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব হবে। পুঁজি সঙ্কটে পড়ে অনেক তাঁতি তাদের শেষ সম্বল তাঁত বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের মতো ঐতিহ্যবাহী বাবুরহাট, গাউছিয়া হাট, টাঙ্গাইলের করোটিয়া, বাজিতপুর, বল্লারামপুরহাট, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর কাপড়ের হাট, সোহাগপুর কাপড়ের হাট পাবনার আতাইকুলা হাট, কুষ্টিয়ার পোড়াদহ হাট, কুমারখালী হাটসহ দেশের বড় কাপড়ের হাটে বেচাকেনা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বরেণ্য পণ্ডিত এলাম ডান্ডিসের বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি হতে পারে, কিন্তু লোকসংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বলতে পারি-অবশ্যই পৃথিবীর সম্পদশালী দেশগুলোর একটি’। এই তাঁত শিল্পের হাত ধরেই আন্তর্জাতিক মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বিবি রাসেল। রফতানি পণ্যের তালিকায়ও তাঁতজাত পণ্যের তুলনা নেই। দেশীয় তাঁতের শাড়ি টেকসইও বেশি। আমাদের তৈরি তাঁতসামগ্রী পুরো বিশ্বে ব্র্যান্ডেড পণ্য হিসেবে সমাদৃত হলেও আমাদের সীমাহীন অবহেলার কারণে এই শিল্প আজ বিপন্ন হতে বসেছে। বিদেশি নিম্নমানের পোশাকে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। পার্শ্ববর্তী দেশের নিম্নমানের পোশাকের বাজার সৃষ্টি করার লক্ষ্যে একটি মহল দেশীয় তাঁত শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁত শিল্পকে বিশ্ববাজারে আগের সেই অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য সরকারের উচিত তাঁত বস্ত্র শিল্প পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করা। আমদানি নিষিদ্ধ করা হলে দেশীয় তাঁত শিল্প বাঁচবে। শ্রমিক বাঁচবে। আমাদের দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থে বিদেশি নকল জামদানি শাড়ি-কাপড় আমদানি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের দেশের কাপড় আমদানিকারকদের বিদেশি কাপড় আমদানি কমিয়ে দেশের পণ্য বিক্রিতে দেশবাসী উত্সাহ জোগাতে হবে। জামদানি শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁতিদের সরকারিভাবে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে তাঁতিরা আমাদের দেশের গৌরবময় এ জামদানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারে। এতে যে শুধু তাঁতিদের লাভ হবে তা নয়, এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে পারলে একদিকে যেমন কমবে আমাদের দেশের বেকারত্ব, অপরদিকে এ শিল্পে তৈরি পণ্যসামগ্রী বিদেশে রফতানি করে চাঙ্গা হবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর