মা দিবস ১৪০০ এতিমের মা

সিন্ধুতাই সাপকাল। মহারাষ্ট্রের এই নারীর বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। এমনিতে তাঁর তিন ছেলে আর এক মেয়ে—মমতা। কিন্তু তাঁকে মা বলে জানে প্রায় ১৪ শ ছেলে-মেয়ে। এদের কাউকে তিনি কুড়িয়ে এনেছেন রেলস্টেশন থেকে, কাউকে ডাস্টবিন থেকে। কাউকে আবার উদ্ধার করে এনেছেন রাস্তার কুকুরের মুখ থেকে। তাদের সবাইকেই তিনি মায়ের মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন। এদের সবাইকে নিয়েই তাঁর বিশাল পরিবার। আর তাই তাঁর নামই হয়ে গেছে ‘এতিমদের মা’।

সিন্ধুতাইয়ের এই এতিম ছেলে-মেয়ের সবার জীবনেরই করুণ কোনো গল্প আছে। তবে তাদের সবার চেয়ে বোধ হয় সিন্ধুতাইয়ের নিজের গল্পটাই সবচেয়ে করুণ। তিনি জন্মেছিলেন ওয়ারদার এক গরিব পরিবারে। পড়াশোনা করতে পেরেছেন মাত্র ৯ বছর বয়স পর্যন্ত। তার পরই তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় ৩০ বছরের এক যুবকের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ১০ বছর সংসার করেন সিন্ধুতাই। তাঁদের তিন ছেলেও হয়।

তাঁদের গ্রামে বন বিভাগের এক কর্মী চুটিয়ে ব্যবসা করছিল। গ্রাম থেকে সব গোবর নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত বন বিভাগে। কিন্তু গ্রামের মানুষকে দিত না ফুটো পয়সাও। সিন্ধুতাইয়ের প্রতিবাদের কারণে তার এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষকে টাকা দিতে বাধ্য হয় সে। লোকটা প্রতিশোধ নেয় সিন্ধুতাইয়ের স্বামীর কান ভারী করে। তখন সিন্ধুতাইয়ের পেটে মেয়ে মমতা। তিনি ৯ মাসের গর্ভবতী। এমন সময় তাঁর স্বামী তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। আত্মীয়-স্বজনও কেউ তাঁকে ঘরে নিল না। এক গোয়ালঘরে মমতার জন্ম দিলেন সিন্ধুতাই। একটা পাথরের টুকরা দিয়ে ঘষে ঘষে কাটলেন নাড়ি। তারপর আর কোনো উপায় না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে নামলেন ভিক্ষায়।

এই ভিক্ষা করতে নামার পরই আবিষ্কার করলেন, অসংখ্য এতিম ছেলে-মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় থাকছে, রাস্তায় খাচ্ছে, রাস্তায় ঘুমাচ্ছে। তাঁরা মা-মেয়ে দুজন—সিন্ধুতাই আর মমতা ভিক্ষা করে যা পেতেন, আশপাশের ওই এতিম ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ভাগ করে খেতে শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করলেন, বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে নিয়মিত তাঁর সঙ্গে থাকতে শুরু করেছে। এরা নিয়মিত তাঁর কাছে খেতে আসে। ধীরে ধীরে দলটি বড় হতে লাগল। কিন্তু তাঁর পক্ষে তো এতজনকে খাওয়ানো সম্ভব নয়। ভিক্ষা করে আর কতটুকুই বা খাবার জোটানো সম্ভব। শেষ পর্যন্ত একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কিন্তু পারলেন না। শেষ মুহূর্তে এক ভিক্ষুক তাঁর কাছে পানি চাইল। পানি দিতে গিয়ে দেখেন, লোকটির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মরার চিন্তা বাদ দিয়ে লোকটিকে সুস্থ করতে লেগে গেলেন। ওই ভিক্ষুকের সেবাযত্ন করতে করতেই তাঁর মনোজগতে আমূল পরিবর্তন এলো। ঠিক করলেন, মরে গিয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে তিনি অন্যদের জন্য বেঁচে থাকবেন। মানুষের সেবা করার জন্য বেঁচে থাকবেন। এবার পূর্ণোদ্যমে তাঁর এতিম বাচ্চাদের দলের জন্য কাজে নামলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য টাকা তুলতে লাগলেন। তাদের খাওয়াতে-পরাতে লাগলেন। আর তাদের দিতে লাগলেন মায়ের ভালোবাসা-মমতা।

সিন্ধুতাই এতিম ছেলে-মেয়েদের জন্য একে একে গড়ে তুলেছেন ছয়টি এতিমখানা। তিনটি ছেলেদের আর তিনটি মেয়েদের। এই ছয় এতিমখানায়ই থাকে তাঁর সব ছেলে-মেয়ে। তিনি শুধু এই ছেলে-মেয়েদের খাওয়া-পরারই বন্দোবস্ত করেননি, তাদের দেন সত্যিকারের পরিবারের আশ্রয়। তাদের ভালো-মন্দেরও দেখাশোনা করেন তিনি। কেউ যেন খারাপ পথে পা না দেয়, নষ্ট না হয়ে যায়, সেদিকেই বরং তাঁর মনোযোগ বেশি। এমনকি সরকারি এতিমখানার মতো ১৮ বছর হলেই তাদের ছেড়ে দেন না। তাঁর মতে, তখনই আসলে ছেলে-মেয়েদের পারিবারিক আশ্রয় বেশি দরকার। ওই সময়ই মানুষ বেশি দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, হতাশায় বেশি আক্রান্ত হয়। তাই সত্যিকারের পরিবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত কেউ সিন্ধুতাইয়ের এতিমখানা ছেড়ে যায় না। তাদের অনেকের বিয়েও দিয়েছেন তিনি নিজে।

আর তাঁর এই পরিশ্রমের ফলও ফলেছে, ফলছে। সত্যি সত্যিই তাঁর ছেলে-মেয়েরা নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে। অনেকে তো সমাজের উঁচু পর্যায়েও চলে গেছেন। হয়েছেন ডাক্তার, অধ্যাপক, আইনজীবী। সিন্ধুতাই পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাত শ সম্মাননা-স্বীকৃতি আর পদক। সেই সব সম্মাননা-পদকের সঙ্গে যে টাকা-পয়সা পেয়েছেন, সেগুলো ব্যয় করেছেন এতিমখানাগুলো গড়তে। আর সাহায্য করেছে তাঁর সন্তানরা। তাঁর যেসব সন্তান প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে, কেউই তাদের পরিবারকে ভুলে যায়নি। শুধু তাদেরই নয়, এই বিশাল কর্মযজ্ঞে তিনি পাশে পেয়েছেন তাঁর নিজের মেয়েকেও। মমতাও অবশ্য নিজের পায়ে শক্তভাবেই দাঁড়িয়েছেন। সাইকোলজিতে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করেছেন সোশ্যাল ওয়ার্কের ওপর। আর পড়াশোনা শেষ করে এসে যোগ দিয়েছেন মায়ের সঙ্গে। সিন্ধুতাইয়ের জীবনকাহিনি নিয়ে ২০১০ সালে মুক্তি পায় মারাঠী চলচ্চিত্র ‘আই এম সিন্ধুতাই সাপকাল’।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর