জমি যার-বাঁধ তার-কৃষককে রাখুন কেন্দ্রবিন্দুতে

এবারের ভয়াবহ হাওর বিপর্যয়ের পর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সীমাহীন দুর্নীতির কবল থেকে হাওর ও বোরো ফসল রক্ষায় বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে জাতীয় হালকা মেজাজের নয় বরং এইসব পরামর্শ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গুরুত্ববহ। তেমনই একটি পরামর্শ এসেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি তদন্ত দলের মতবিনিময় সভায়। পরামর্শটি হলো ‘জমি যার-বাঁধ তার’ দর্শন বাস্তবায়নের। এই ‘যার-তার’ দর্শন আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সগর্ব উপস্থিতি দেখি আমরা। যেমন জাল যার জলা তার নীতিটি অনুরূপ দর্শনের আওতায় উদ্ভাবিত ও প্রযুক্ত হলেও প্রয়োগক্ষেত্রে এর ভিন্ন রূপ দেখে আমরা হতাশ হচ্ছি। ‘জমি যার-বাঁধ তার’ এই দর্শনের আওতায়ই মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসি’র মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের সূচনা ঘটানো হয়েছিল। সরকার মনে করেছিল যেহেতু পিআইসি সদস্যরা সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্যরাই, তাই কাজের প্রতি তাঁদের দরদ থাকবে। কার্যত আমরা এর উল্টো অবস্থাই বরং দেখে আসছি। ঠিকাদারদের সাথে বিভিন্ন পিআইসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও উঠে আসছে জোরেসোরেই। সুতরাং শুধু নীতিমালা প্রণয়ন করলেই যে চলবে না এটি এর বড় উদাহরণ। মূলত দেশের কোন নীতিমালাই খারাপ নয়। যে নীতিগুলো রয়েছে সেগুলোই যদি সততা ও আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়িত হত তাহলে নতুন নীতির কোন প্রয়োজন হত না। আসলে সমস্যা নীতিতে নয় মূল সমস্যা হলো বাস্তবায়নে। তাই নীতির চাইতে বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। তবে বাস্তবায়নের জন্য একটি নীতিমালা চাইÑএতে কোন দ্বিমত কারোরই থাকার কথা নয়।
আসলে হাওরের সমস্যা মোকাবিলা করতে বহুমুখী প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। আমরা জানি হাওর উন্নয়নের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড। আমরা জানি না ওই মহাপরিকল্পনায় কী আছে। অবিলম্বে ওই মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করা উচিৎ। হাওর সুরক্ষায় নদী ও খাল-বিল খনন, ধানের আগাম ও বন্যাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন, যথাযথভাবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার বিষয়গুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য যাতে কৃষকরা পেতে পারেন সেই ব্যবস্থাটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এরমধ্যে জমি যার-বাঁধ তার নীতিটি অবশ্যই একটি জুৎসই নীতি হতে পারে বৈকি। যে দুর্নীতি করে সে নাকি সাগরের ঢেউ গুনেও সেটি অবলীলায় করে যেতে পারে। সহসা আমাদের এই দুর্নীতিপ্রবণ মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে এমনটি আশা করা নিতান্তই বোকামি। তাই দুর্নীতি আটকানোর যত উপায় আছে তার সবগুলোই প্রযুক্ত করতে হবে। বহুমুখি তদারকী ব্যবস্থার পাশাপাশি, আইনি ব্যবস্থাগুলোর সচলায়তন ঘটানো অপরিহার্য বটে।
এবার দেশের অন্যতম বৃহৎ খাদ্যভা-ার এই হাওরাঞ্চল জাতীয় গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পেরেছে। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে হাওর সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষে সব মহলকে অতিশয় তৎপর হতে হবে। যেসব শক্তিশালী তদন্ত দল আসছেন তাদেরকে অনুরোধ করব, আপনারা শহুরে সুধী সমাজের মতামতের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে কৃষকদের মতামত জানুন। তারা হাওর নিয়ে কী ভাবছেন সেটি অনুধাবন করুন। মনে রাখা দরকার, কৃষকরাই হলো আসল বিজ্ঞানী। তারা জানেন কীভাবে হাওরকে রক্ষা করতে হয়। ভূমির সাথে সম্পর্কহীন ব্যক্তিদের তাত্ত্বিক আলোচনার চাইতেও কাদামাটি গায়ে লাগা কৃষকদের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা অনেক মূল্যবান। হাওর নীতিমালার কেন্দ্রবিন্দুতে তাই কৃষকদের অবস্থানটিই সুদৃঢ় করা দরকার বলে আমরা মনে করি। এই বিষয়টি নিশ্চিত করলেই জমি যার-বাঁধ তার নীতির স্বার্থকতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর