মাশরাফির খেরো খাতা

আপাতত কিছুদিন ক্রিকেট থেকে বহুদূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। না নিয়ে উপায় কী? সেই ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে শুরু, এরপর পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিরামহীন ক্রিকেট যে নিংড়ে নিয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে! এ তো আর শুধু নিজের কোটার ওভারগুলো নিরাপদে করে ফেলা নয়, প্রত্যাশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাঠে এবং মাঠের বাইরে পুরো দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার কষ্ট তো সীমাহীন। ‘শরীরের ওপর দিয়ে যা গেছে, তার বহুগুণ গেছে ব্রেনের ওপর দিয়ে’, তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডের সিরিজ শেষে পাওয়া অবসরে ক্রিকেটে ডুব দিতে চান না তিনি। কিন্তু ক্রিকেট থেকে কি আর দূরে থাকতে পারেন মাশরাফি। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিনে বাংলাদেশের বোলিং দেখে আর সবার মতো বিস্মিত হন, কারণ ছয় মাস আগেও এমন কিছু যে দূর কল্পনাতেও দেখেননি তিনি!

‘যদি বলি এমন কিছুই হবে বলে আশা করেছিলাম, তাহলে মিথ্যা বলা হবে। তাই অবাক লাগে, তার চেয়েও বেশি ভালো লাগে এটা ভেবে যে আমি এ দলটার সদস্য’, ছুটির কিছু অংশ নড়াইলে কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে কাল বলছিলেন মাশরাফি। নিজের ভাণ্ডারে সাফল্যের এমন মণি-মানিক্য যে বিশ্বকাপের আগে হোম সিরিজে জিম্বাবুয়েকে টেস্ট আর ওয়ানডে মিলিয়ে ৮-০তে হারানোর কৃতিত্ব আর ঝাড়পোছ করেন না তিনি। আর সবাই যেটাকে স্বপ্নের দৌড় বলছেন, সেই অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত চট্টগ্রাম টেস্টে নিজের খেরোখাতাতেই চোখ বুলান আর তৃপ্ত হন মাশরাফি, ‘ছয় মাস টানা ভালো খেলে যাব, এতটা ভাবিনি। আমাদের ট্রেন্ডই তো ছিল একটা ভালো ম্যাচের পর অনেকগুলোয় খারাপ খেলা। বিশ্বকাপ মিশন শেষেই বলেছিলাম দেশে আমাদের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। তিনটি বড় দলের বিপক্ষে টানা সিরিজ খেলার অভ্যাস আমাদের নেই। সত্যি বলতে কি তখন লক্ষ্য ছিল সিরিজ তিনটায় যেন ভালো ক্রিকেট খেলতে পারি। যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে বহুগুণ ভালো খেলেছি। পাকিস্তানকে ৩-০, ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে ২-১ ম্যাচে সিরিজ জেতার কথা ছয় মাস আগে অন্তত ভাবিনি, ড্রেসিংরুমে এমন কোনো আলোচনাও হয়নি।’

বড় দলের বিপক্ষে আগেও এক-আধটা ম্যাচ জিতেছে। কিন্তু উৎসবের রং মুছতে না মুছতেই ব্যর্থতার গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে সব কিছু। এক যুগেরও বেশি বয়সী আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মাশরাফি নিজেও এমন উন্থান-পতন কত্ত দেখেছেন! ‘খেলায় হারজিত আছে। অস্ট্রেলিয়াও হারে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে, এটা আমাকে দারুণ আনন্দ দেয়’, মাশরাফির আনন্দ অবশ্য অন্য একটি কারণে আরো বেশি, ‘মাঠে আমাদের ক্রিকেটারদের অ্যাটিচুড। হারার আগে কেউ হারে না। বড় দল জেতে, হারে আবার জেতে। এবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ক্যারেক্টারটা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি সিরিজ এবং প্রথম ওয়ানডেতে হারের পর অনেককেই বলতে শুনেছিলাম যে এবার আর হবে না। কিন্তু আমরা বিশ্বাস হারাইনি। আমরা পরের দুটি জিতেছি। অবশ্য হারজিতটা আমার নিজের কাছে খুব বড় নয়। আমি সেই ক্যারেক্টারটা দেখতে চেয়েছিলাম- হারার আগে না হারার মানসিকতা। ছেলেরা সেটাই দেখিয়েছে এবং আমরা জিতেছি। আমি সিরিজ জেতার চেয়ে বেশি খুশি মাঠে সবার লড়াই করার মানসিকতা দেখে।’

মানসিকতায় এ পরিবর্তন এলেও বাংলাদেশকে এখনই বড় দলের তকমা পড়িয়ে দিতে নারাজ মাশরাফি, ‘আমি অতটা মনে করি না। দেখুন, আমরা ছয় মাস ধরে সাফল্য পাচ্ছি আর বড় দলগুলোর সঙ্গে সাফল্যের পরিচয় দীর্ঘদিনের। আমি দেখতে চাই সেই বাংলাদেশ দলকে, যারা হারার পরও মাথা তুলে লড়াই করতে জানে। ওই যে বললাম, এখন আমরা নিয়মিত জিতে চলেছি। কিন্তু এমন একটা সিরিজ আসবে, যেটা আমরা হারব। আবার সেই হারের হতাশা ভুলে পরের সিরিজেই ঘুরে দাঁড়াব। বড় দল হতে আমাদের আরো কয়েকটা হার্ডল পার হতে হবে। সেদিন হয়তো আমি নাও খেলতে পারি, কিন্তু বাইরে থেকে সেদিন গর্ব করব- এই দলটায় আমি খেলতাম!’ সময়সীমাও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন মাশরাফি, ‘আমার বিশ্বাস পাঁচ-সাত বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ এমন একটা দলে পরিণত হবে, যে দলটা বিশ্বকাপে অংশ নেবে অন্যতম ফেভারিট হিসেবে।’

সে পর্যায়ে দলকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা সৌম্য-সাব্বির-মুস্তাফিজদের ‘ইয়াং ব্রিগেড’কেই নেওয়ার তাগিদ মাশরাফির, ‘দলের তরুণরা দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলছে। তবে ওরা কেবলই শুরু করল। ওদের আমি গ্রেট বলব তখনই যদি ওরা আরো ১০ বছর বাংলাদেশকে সার্ভিস দিতে পারে। আর ওরা যদি সেটা পারে, তাহলে সত্যিকারের বড় দলে পরিণত হবে বাংলাদেশ, দেখবেন তখন টেস্টেও সাফল্য আসবে নিয়মিত।’

টেস্ট ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ধরা পড়ছে মাশরাফির, ‘বড় দলগুলো আগে টেস্টে ভালো খেলে পরে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে উন্নতি করেছে। আমাদের উন্নতির ক্ষেত্রটাই ওয়ানডে ক্রিকেট। চট্টগ্রাম টেস্ট দেখে অনেকের মনে হতে পারে তাহলে ঢাকায় জিতবে না কেন বাংলাদেশ? আমি তাদের দলে নই। ওয়ানডেরও সবটা আমরা এখনো শিখিনি, টেস্টে আরো পিছিয়ে। এ বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না।’

তবে ভালো-মন্দ না, মাশারাফির চাওয়া ‘ক্যারেক্টার’, ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার মানসিকতাটা দেখতে চাই, যা বিশ্বকাপ থেকে আমরা দেখিয়ে আসছি। আমি নিশ্চিত সেটা দেখতে পাবও, ইনশাল্লাহ!’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর