হাওর অঞ্চলের কৃষকের কান্না না থামতেই এবার ডুবে গেছে দেশের উত্তরের জেলা সিরাজগঞ্জ, নাটোরসহ ৪ জেলা নিয়ে বিস্তৃত চলনবিলের বড় একটি অংশ। এর আগে ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জসহ ৭ জেলার হাওরে উঠতি ফসল তলিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় হাওর পাড়ের কৃষক। ধান কাটা মৌসুম শুরুর প্রাক্কালে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এসব এলাকার কৃষকের স্বপ্ন। একই অবস্থা ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, নরসিংদী, লক্ষ¥ীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের আরো কয়েকটি জেলার। আধাপাকা ধান ডুবে যাওয়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন এসব এলাকার কৃষক। অনেক এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান ডুবে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন তারা। পানির নিচে তলিয়ে থেকে পচে আরো ক্ষতি এড়াতে অনেকেই আতঙ্কে আধাপাকা ধান কেটে নিচ্ছেন। এখনো অক্ষত নতুন নতুন এলাকায় যাতে পানি ঢুকে না পড়ে সে লক্ষ্যে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে রাতদিন প্রাণান্তর চেষ্টা চলছে।
নাটোর জেলা সংবাদদাতা জানান, বুধবার সন্ধ্যা থেকে চলনবিলের পানি আর বৃদ্ধি না পাওয়ায় নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি বর্তমানে স্থিতিশীল রয়েছে। একদিকে কাল বৈশাখী ঝড় ও অনাকাক্সিক্ষত ভারী বর্ষণ, অপরদিকে আগাম বন্যার আশঙ্কায় চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়া উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আধাপাকা বোরো ধান কেটে নিচ্ছে। একারণে চলতি মৌসুমে জেলায় বোরো ধানের উৎপাদন ব্যাপকহারে হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ ধান কাটতে মাইকিংয়ের বিষয়টি গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের দাবি, হঠাৎ করে ভারি বর্ষণে সিংড়া উপজেলার ৬০ হেক্টর জমির পাকা ধান সম্পূর্ণ ও ৩০০ হেক্টর জমির ধান আংশিক নিমজ্জিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আতঙ্কিত হয়ে এসব জমির ধান কেটে নিয়েছে।
এদিকে সিংড়া উপজেলা প্রশাসন ক্ষতি নিরূপণসহ আগাম দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় ঠিক করতে সিংড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও ১২ ইউপি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে বুধবার জরুরী বৈঠক করেছেন। বৈঠকে গত সোমবার উপজেলার ৫টি গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শিলা বৃষ্টিসহ কালবৈশাখী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া মাইকিং-এর গুজবে ধান কাটা নিয়ে কৃষকদের সর্তক করার জন্য ইউপি চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ের আগে আস্বাভাবিক বর্ষণে কৃষকদের করণীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনার প্রদানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত রবি ও সোমবার হঠাৎ ভারি বর্ষণে ও আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে চলনবিলের ডাহিয়া, কলম, চৌগ্রাম, ও শেরকোল ইউনিয়নের নেঙ্গুইন, পাটকৈল, তেলিগ্রাম, ডাহিয়া বেরাবাড়ি,সরিষাবাড়ি ও চৌগ্রাম বিলের কয়েকশ হেক্টর বোরো জমি প্লাবিত হয়। এসব জমির আধাপাকা ধান পানিতে তলিয়ে যায়। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগসহ জনপ্রতিনিধিরা নদীর পানি প্রবেশ রোধে পাটকৈল ও তেলীগ্রাম এলাকায় অস্থায়ী বাঁধ তৈরী করে দিয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় থেকে বিলের পানি কমতে শুরু করার প্রেক্ষিতে অচিরেই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাটকৈল গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি ১২ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। কিন্তু আগাম বর্ষণে তার সব জমির তলিয়ে গেছে। তিনি মাত্র এক বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছেন। অবশিষ্ট জমির ধান এখনও পানির নিচে। ষাটোর্ধ্ব বয়সী আব্দুল গফুর জানান, চলনবিল এলাকায় অন্তত ২০ বছরেও বর্ষণে এমন ফসল ডোবার ঘটনা ঘটেনি।
বেরাবাড়ি গ্রামের আবুল কাশেম জানান, মে মাসের শেষ দিকে এমন বৃষ্টি হয়। কিন্তু এবার এপ্রিল মাসেই ভারি বর্ষণ তাদের দিশেহারা করেছে। এমন বৃষ্টি তিনি কখনও দেখেননি। ১০ বিঘা জমির সব ধান এখন পানির তলে।
তেলিগ্রাম বিল এলাকার কৃষক হাতেম আলী জানান, ধান ডুবেছে বলে কেটেছি। জোড়মল্লিক গ্রামের অপর কৃষক রমজান আলী জানান, বছরে একটি মাত্র আবাদ এই বোরো ধান। ৫০ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছেন। খরচ হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এখন উৎপাদনের খরচই উঠবে না। ধান না পেলে তারা পথে বসবে।
সেরকোল ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাফর হোসেন জানান, বাঁধগুলো ভাল থাকলে এমন ক্ষতি হতো না। তিনি অবিলম্বে বাঁধগুলো সংস্কারের দাবী জানান।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সিংড়া উপজেলায় ৩৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছ্ েএর মধ্যে গত দু’দিনের ভাড়ি বর্ষণে প্রায় ১৫শ’ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন জানান, ভারী বর্ষণে ডাহিয়া, চৌগ্রাম, ছাতারদিঘী ইউনিয়ন ও সিংড়া পৌর এলাকায় ৩৬০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই তিনটি ইউনিয়নসহ পৌর এলাকায় মোট আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ৯৫ হেক্টর জমি। ভারী বর্ষণের পর কৃষি বিভাগ থেকে ধান কাটার জন্য কোন ধরনের মাইকিং করা হয়নি। বর্তমানে আবহাওয়া ভাল রয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ২/৩ দিনের মধ্যে পানি কমে যাবে বলে আশা করছেন তারা।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফি জানান, গত দু’দিন কৃষকদের মাঝে কিছুটা আতঙ্ক থাকলেও আবহাওয়া ভাল হওয়ার কারণে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। নদীর বাঁধগুলো দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় এবার এমনটি হয়েছে। এবার বাঁধগুলো সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। তিনি কৃষকদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন। একই সাথে তিনি কোন গুজবে সারা না দিতে তাদের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল আহসান জানান, স্থানীয়ভাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫শ’ হেক্টর বলা হলেও কৃষি বিভাগের হিসেব অনুযায়ী ৩৬০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এরমধ্যে কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ৬০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে ইতিমধ্যে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ১৬৫০ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করতে বলা হয়েছে।
ল²ীপুরে গত ১৯ এপ্রিল থেকে টানা বর্ষণে জেলার রামগতি, কমলনগর ও রায়পুরসহ ৫ উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির রবি শস্য পানিতে তলিয়ে গেছে। সবজি, বাদাম, মরিচ ও ডাল জাতীয় রবি ফসলে পচন ধরায় ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ফসল ডুবে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষক। কৃষি বিভাগ জানায়, জেলায় এ বছর ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩শ’ ২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর।
এদিকে, সুনামগঞ্জে মাছ, পাখি, কীট-পতঙ্গের পরে গবাদি পশু মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা আতঙ্কিত করেছে পুরো অঞ্চলকে। স্থানীয় প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তারা মৃত গবাদিপশুর রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করছেন-যাতে কোন কারণে গবাদি পশু মারা যাচ্ছে- তা নির্ধারণ করা যায়।
নেত্রকোনায় ফসল ও মৎস্যখাতের ক্ষয়ক্ষতি হাজার কোটি টাকা
এ কে এম আব্দুল্লাহ, নেত্রকোনা থেকে : ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল ও নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রাথমিকভাবে প্রায় এক হাজার কোটির টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জেলা মৎস্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজ সময়মতো সঠিকভাবে সম্পন্ন না করায় চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হওয়া অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার অধিকাংশ হাওরের বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও অতি বর্ষণের কারণে বারহাট্টা, আটপাড়া, কেন্দুয়া, কলমাকান্দাসহ আরও কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ জেলার কয়েক লাখ মানুষ।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিলাশ চন্দ্র পাল জানান, আগাম বন্যার পানিতে এ পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৭ শত ১০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। যা থেকে ৪ লাখ ২১ হাজার ৯ শত ৮০ মেট্রিক টন ধান এবং ধান থেকে ২ লাখ ৮১ হাজার ৩ শত ২০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হতো। বর্তমান বাজার মূল্যে যার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ৯ শত ৫৬ কোটি ৪৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
অন্যদিকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ. আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, পানি দূষণ ও অক্সিজেনের অভাবে জেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর, গণেশের হাওর, তলার হাওর, জালিয়ার হাওর, চৌতারা হাওরসহ ছোট-বড় ৪২টি হাওরে মাছের মড়ক দেখা দেয়। এতে নষ্ট হয়ে গেছে ১ হাজার ১ শ’ ৮০.৮৫ মেট্রিক টন মাছ। এতে ক্ষতির শিকার হয়েছেন ১৬ হাজার ৫ শ’ ২৮ জন জেলে। সরকারি হিসেব মতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জেলার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও বারহাট্টা উপজেলায় মৎস্য খাতে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ ধরা হয়েছে আনুমানিক ২৪ কোটি টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানায়, বন্যার পানি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবার তারা আগাম ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপণ করেছিলেন। কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হলো না। ক্ষতিগ্রস্তরা দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, ‘পানি আসার আগে হাওর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। সময়মতো সঠিকভাবে হাওর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজ শেষ না করার কারণেই ঢলের পানি এসে সরাসরি হাওরে ঢুকে আমাদের সব স্বপ্ন তলিয়ে গেছে।’
এ ব্যাপারে নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু তাহেরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‹বাঁধে অধিকাংশ কাজই হয়ে গিয়েছিল। এরমধ্যে হাওরের ঠিকাদারদের ৬০-৬৫ ভাগ কাজের বিলও দেয়া হয়ে গেছে।›
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক ড. মো. মুশফিকুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বন্যা দুর্গতদের মাঝে ৩ শত ৬৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে বিনা মূল্যে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫শ’ টাকা করে দেয়া হবে।
মৌলভীবাজারের হাওর পাড়ের প্রায় ২ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ
বোরো ফসল ধান ও মাছ হারানোর পর পূরোদমে হাকালুকি পারের মানুষ এখন অসহায়। হাওর পাড়ে চলছে সুনশান নীরবতা। বছরে একবার ফসল হয় এই হাওরে, আর এ ফসল তোলে পূরো বছরের খাবার ও অন্যন্য খরচ নির্বাহ করেন। কিন্তু কয়েক দিনের টানা বর্ষনে কৃষক ও জেলে পরিবারের উলট-পালট হয়ে গেল। অসহায় মানুষ আহাজারি করেছেন কি ভাবে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকবেন। সরকারী ভাবে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা একবারে অপ্রতুল।
মৌলভীবাজার জেলায় পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ৭টি উপজেলার লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করা হয়েছে। জেলার ৬৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ সংখ্যা ৬০টি ইউনিয়ন। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সংখ্যা ২৪,৮৭১টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪৯,৭২৩টি পরিবার। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা ১,২১,৬০৬ জন ও আংশিক ২,৫৮,৩৪৮জন হাওর পারের মানুষ। সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ঘরবাড়ি ৮৯১ টি ও আংশিক ৫,৯১০টি। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১৮,৮৯৮ হেক্টর জমির বোরো ফসল । মাছ মরেছে ২৫ মেট্রিক টন। হাওরে হাঁস, ছাগল ও গরু মারা যাওয়ার পরিসংখ্যন এখনও নিরুপন করা যায়নি বলে জানায়।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ফসল হারানো দুর্গত মানুষদের জন্য জিআর ২০০ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্ধ এসেছে। যা ইতো মধ্যে বিতরণ করা শুরু হয়েছে। প্রতি পরিবার কে ৫০০টাকা করে ৩ মাস দেয়া হবে। ৯৮ মেট্রিকটন ভিজিএফ প্রতিপরিবারে ১মাসের জন্য ৩০ কেজি ১ হাজার পরিবারকে দেয়া হবে।
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে হাকালুকি হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অনেকে এখোনও ত্রান পাননি বলে অভিযোগ করেন। ভুকশিমইল এলাকায় উস্তার আলী, রমজান আলী জানান ত্রাণের চাল নিয়ে অনেকেই ঘরে ফিরলেও লাইনে দাঁড়িয়ে তারা কোন প্রকার ত্রাণ না পেয়ে ঘরে ফিরেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২২ হাজার ৮শত কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থেমে থেমে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫৪৫০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ হাজার ৮শত কৃষক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কোনো ধরণের সরকারি সাহায্য পায়নি।
জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাসিরনগর উপজেলা। গত কয়েকদিনে বৃষ্টিতে নাসিরনগরে প্রায় ৩ হাজার ৩ শত ১০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। এই উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ হাজার ১শত ২৫জন কৃষক। এরপরই বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার বিজয়নগর উপজেলা। ওইসব এলাকার কৃষকরা পানিতে ডুবে থাকা জমির পাকা ধান কাটতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়েছে। তবে ওইসব এলাকার পানিতে কোনো দূষণের আলামত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ আবু নাছের গতকাল বৃহস্পতিবার জানান, বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৫৪৫০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে প্রায় ২২ হাজার ৮শত জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করছেন।
নওগাঁর কৃষক দিশাহারা
নওগাঁর পোরশায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্রায় ৩শহেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে পানির নিচে। কৃষকেরা দিশাহারা হয়ে পানির নিচ থেকে আধা-পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছে। জানা গেছে, ভারতে অতিবৃষ্টির কারনে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর থেকে নেমে আসা ঢলে পোরশা সীমান্তের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পূর্ণভবা নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ফলে ধান গুলি তলিয়ে যায়। পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবার রহমান জানান, উপজেলার নিতপুর, মহাডাংগা, কোঁচনা ও বাঁকইল সহ কয়েকটি এলাকার ৩শহেক্টর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তিনি তলিয়ে যাওয়া এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং এব্যাপারে অধিদপ্তরে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন বলে জানান।
ফুলপুরে পানি কমতে থাকলেও হাহাকার কৃষকের মাঝে
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিংহেশ্বর, ফুলপুর, ছনধরা, ভাইটকান্দি, বালিয়াসহ কয়েকটি ইউনিয়নের নিচু এলাকার কয়েক হাজার একর জমির বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে। চোখের সামনে তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন বোরো ফসল। তাদের কষ্টে অর্জিত বোরো ধান অশান্ত প্রকৃতির কাছে আজ যেন বড় অসহায়। কৃষকরা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অবশেষে আধাপাকা ধান বাধ্য হয়ে কাটছেন। অনেকে পানি বেশি থাকায় ধান ঘরে তোলার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। গত দু’দিন যাবৎ বৃষ্টি না থাকায় বৃহস্পতিবার থাকে তলিয়ে যাওয়া বোরো ফসলের জমি থেকে পানি কমতে শুরু করলেও কৃষকদের হাহাকার ও কান্না কিছুতেই থামছে না। কারণ ইতিমধ্যেই অনেক কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ভেঙ্গে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। হারিয়ে গেছে মুখের হাসি। বিশেষ করে ফুলপুর উপজেলার সিংহেশ্বর, ফুলপুর, ছনধরা, ভাইটকান্দি, রামভদ্রপুর, বালিয়াসহ কয়েকটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার একর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অনেক কৃষক পানির মাঝে কলা গাছের ভেলা তৈরী করে আধাপাকা ধান কেটে আনার চেষ্টা করছেন। অনেক কৃষক তাদের ধান ঘরে তোলার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
নরসিংদীর মেঘনা তীরবর্তী অর্ধশতাধিক গ্রামের আধাপাকা বোরো ধান তলিয়ে গেছে
উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে নরসিংদীর মেঘনা তীরবর্তী চরাঞ্চলে বোরো ধান তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। গত ৩ দিনে মেঘনায় ৬৮ সেমি. পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় রায়পুরার চানপুর, পাড়াতলী, বাঁশগাড়ী, চরমধুয়া, নিলক্ষা ও শ্রীনগর এলাকার কমবেশী ১০০০ হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধান, মিষ্টি আলু, বাদাম ক্ষেত এবং মরিচ ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। চানপুর এলাকার লোকজন জানিয়েছে এলাকার সদাগরকান্দী, কুড়েরপাড়, মোহিনীপুর, মজিদপুর, সুজাতপুর, কালিকাপুর, বগডহরিয়া, চানপুর ও মাঝেরচর এলাকার আধাকাঁচা আধাপাকা বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অভিজ্ঞ কৃষকরা জানিয়েছে, পানি ২/১ দিনের ভিতর চলে গেলে ধানের তেমন কিছু ক্ষতি সাধিত হবে না। কিন্তু পানি বেশীদিন স্থায়ী হলে ধান পচে বিনষ্ট হয়ে যাবে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে মেঘনার পানি হ্রাস না পাওয়ায় চাষিরা বাধ্য হয়ে আধাপাকা ধানই কাটা শুরু করেছে। তবে পানির নিচ থেকে ধান কেটে আনা সম্ভব নয় বিধায় শুধু ধানের শীষগুলো কেটে আনছে। এছাড়া পানির চিনে তলিয়ে গেছে প্রায় সমসংখ্যক মিষ্টি আলু, বাদাম ও মরিচ ক্ষেত। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন শাক-সবজি, উচ্ছে, গিমি কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, বাঙ্গি, ক্ষিরাই ইত্যাদি। একই অবস্থা দেখা দিয়েছে পাড়াতলী, বাঁশগাড়ী, চরমধুয়া, নিলক্ষা, শ্রীনগর ইত্যাদি অঞ্চলের কমবেশী অর্ধশতাধিক গ্রামের বোরো ধান, বাদাম, মরিচ, মিষ্টি আলুসহ বিভিন্ন শাক-সবজির জমি। সচেতন চাষিরা জানিয়েছে কোন বছরই বৈশাখ মাসের এই সময়ে নদীতে পানি বাড়ার কথা জানা যায়নি। এব্যাপারে নরসিংদী জেলা কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক লতাফত হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মেঘনায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কিছু ধানের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
ময়মনসিংহের ৯ উপজেলায় নিম্নাঞ্চল পানির নিচে
টানা বৃষ্টি ও মেঘালয় থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহ জেলার ৯টি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির বোরোধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, ফুলপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, ভালুকা, ত্রিশাল, নান্দাইল, ময়মনসিংহ সদরের বিভিন্ন ইউনিয়নে ব্যাপক ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। আর এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষক। জেলা কৃষি খামারবাড়ির তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৬৩০ হেক্টরজমিতে বোরোধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৮৩ মেট্রিকটন। ফুলপুর উপজেলায় ৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর, তারাকান্দা সাড়ে ৬০০ হেক্টর, ধোবাউড়া ১ হাজার ২০০ হেক্টর, হালুয়াঘাট ১ হাজার ১০০ হেক্টর, নান্দাইল ৯০০ হেক্টর, ত্রিশাল ৪৫০ হেক্টর, ময়মনসিংহ সদর উপজেলা ১ হাজার হেক্টর, ভালুকা ২ হাজার ৫০০ হেক্টর ও গৌরীপুর উপজেলার ৭০০ হেক্টর জমির বোরো ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা মগটুলার মধুপুর এলাকা থেকে শুরু করে খালবলাবাজার হয়ে কাঁচামাটিয়া নদীসংলগ্ন কয়েকশ’ হেক্টর আবাদি জমির বোরোধান তলিয়ে গেছে। এছাড়া আরও ৩৪টি বিলের নিচু এলাকার শতাধিক হেক্টর জমির আধাপাকা ধান তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।